লিয়াকতের দাবি : অনিরাপদ মনে করেছি তাই গুলি

কোন পরিস্থিতিতে কী কারণে সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করা হয়েছিল তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে মামলার তদন্ত সংস্থা র‌্যাব। এটা কী পরিকল্পিত নাকি তাৎক্ষণিক হত্যা, সেটা নিয়েও চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হচ্ছে। সিনহার নিহতের ঘটনায় করা মামলায় এখন তিন প্রধান আসামি সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও উপপরিদর্শক নন্দ দুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব।

লিয়াকতের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন চেকপোস্টে গুলি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো? জবাবে লিয়াকত দাবি করেছেন, তিন সোর্স তাকে জানিয়েছেন, যারা গাড়িতে আসছেন তারা ডাকাত। এটা বিশ্বাসও করেছিলেন তিনি। ঘটনার সময় নিজেকে অনিরাপদ মনে করেন লিয়াকত। এ কারণে আগেই গুলি ছুড়ে দেন। পরে বুঝতে পারে সোর্স তাকে মিসগাইড করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তিন সোর্স নুরুল আমিন, মো. নাজিমুদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, লিয়াকত দাবি করেছেন, তিন সোর্সের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর এসআই নন্দ দুলালকে নিয়ে দ্রুত এপিবিএনের চেকপোস্টে চলে আসেন তিনি। নন্দ দুলালের মোটরসাইকেলে সিভিল ড্রেসে তারা এসেছিলেন। এদিকে সিনহা হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে সাত দিনের রিমান্ডের জন্য গতকাল শনিবার হেফাজতে নিয়েছে র‌্যাব।

এপিবিএনের সদস্যরা পরিচয় পেয়ে সিনহার গাড়ি ছেড়ে দিলেও চেকপোস্টের শেষ মাথায় ড্রাম ফেলে তা আটকে দেন লিয়াকত। এরপর ঘটে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। গুলি করার ব্যাখ্যায় কিছুটা এলোমেলো তথ্য দিচ্ছেন লিয়াকত। কখনও কখনও বলছেন, তার মনে হয়েছে অপর পাশ থেকে এক রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে। আবার বলছেন, মনে হয়েছে যে কোনো সময় তাদের ওপর গুলি করা হতে পারে। এটাও বলেছেন, ডাকাতের কাছে অস্ত্র থাকতে পারে- এমন আশঙ্কা ছিল তার। বলছেন, অস্ত্র তার দিকে তাক করা হয়েছিল। পুরো ঘটনাটি নিয়ে তার বোঝার ভুল ছিল বলে দাবি করেন লিয়াকত। এমনও বলছেন, এজাহারে যে বক্তব্য রয়েছে, সেটাই তার কথা।

তবে তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এমন কী ঘটেছে ১-২ মিনিটের মধ্যে গুলি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন লিয়াকত। আর অ্যালিয়ন গাড়িতে ডাকাত চলাফেরা করার কথা নয়। ওই গাড়িতে মাদক পাচার হচ্ছে বললেও হয়তো বাস্তবতার সঙ্গে মিলত। ঘটনা নিয়ে প্রদীপ, লিয়াকত ও নন্দ দুলালের বক্তব্যে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ঘটনাস্থলে তাদের নিয়ে গিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আরও অনেক প্রত্যক্ষদর্শীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এদিকে মামলার এজাহারে পুলিশ দাবি করেছিল, মেজর পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি গুলি করতে উদ্যত হলে ৪ রাউন্ড গুলি করে করেন লিয়াকত।

সূত্র জানায়, ঘটনার দিন রাত ৯টা ২৯ মিনিটের দিকে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এরপর লিয়াকত ফোন করেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে। ১০টা ৫ মিনিটের দিকে প্রদীপ ঘটনাস্থলে আসেন। এরপর এখানে-সেখানে ফোন করেন। ঘটনাস্থল থেকে থানার যে দূরত্ব তাতে ওই সময়ের মধ্যে গাড়িতে কারও সেখানে পৌঁছা সম্ভব যদি তিনি ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই রওনা দেন। গুলির পরই ওসির সঙ্গে লিয়াকতের ফোনালাপ হয়। গুলির আগে ফোনালাপের কোনো তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

একটি সূত্র জানায়, গুলি করার পর পানি ও অক্সিজেন চান সিনহা। তাকে তা দেওয়া হয়নি। চিকিৎসা ছাড়া কেন ৫৫ মিনিট তাকে রাখা হয়েছিল, তা জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। প্রদীপ দাবি করছেন, গাড়ি আসার পর পরই সিনহাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে লিয়াকত যে অস্ত্র দিয়ে সিনহাকে গুলি করেছিলেন, সেটি আসলে কার তা নিয়ে তদন্ত চলছে। একটি সূত্র বলছে, ৯ এমএমের ওই পিস্তলটি লিয়াকতের নয়। সেটি নন্দ দুলালের। যে অস্ত্র থেকে গুলি করা হয়েছে, তা তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রদান করতে আদালত আদেশ দিয়েছেন। গতকাল অস্ত্রটি তদন্ত কর্মকর্তা তার হেফাজতে নিয়েছেন। এ অস্ত্রটি এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, চেকপোস্টে হঠাৎ করেই গুলির মতো ঘটনা সাধারণত ঘটে না। আগে বাদানুবাদ হতে পারে। ধস্তাধস্তি হতে পারে। শেষ ধাপে গুলির ঘটনা ঘটতে পারে। চূড়ান্ত যৌক্তিক মনে হলেই গুলি ছোড়া হয়। সিসিটিভি থাকলে পুরো বিষয়টি পরিস্কার হতো। তবে মেরিন ড্রাইভে এপিবিএনের চেকপোস্টে পৌঁছার আগেই বিজিবির চেকপোস্ট পার হয়ে আসেন সিনহা। সেখানে তিনি নিজের পরিচয় দেওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সিনহার আচরণ ছিল স্বাভাবিক। ধীরস্থিরভাবেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন।

এপিবিএনের তিন সদস্য সাত দিনের রিমান্ডে : কক্সবাজার অফিস জানায়, সিনহা হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে ৭ দিনের রিমান্ডের জন্য গতকাল র‌্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সিনহার বোনের করা মামলায় মোট ১৩ জনকে রিমান্ডে নেওয়া হলো। ইতোপূর্বে পুলিশের ৪ সদস্যসহ ৭ জনকে রিমান্ড শেষে আদালতে সোপর্দ করা হলেও ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত ও উপপরিদর্শক নন্দ দুলাল রক্ষিতের রিমান্ডের গতকাল পঞ্চম দিন পার হয়েছে।

শনিবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে এপিবিএনের তিন সদস্যকে কারাগার থেকে র‌্যাবের একটি দল নিজেদের হেফাজতে নেন। এরপর তাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে নেওয়া হয় র‌্যাব-১৫-এর কক্সবাজার সদর দপ্তরে। রিমান্ডে নেওয়া তিনজন হলেন- এপিবিএনের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান, কনস্টেবল রাজীব ও আবদুল্লাহ। সিনহা হত্যা ঘটনার দিন ৩১ জুলাই রাতে তারা এপিবিএনের চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করেন।

গত ১৭ আগস্ট জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাবের একটি দল তাদের হেফাজতে নেয়। পরদিন তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাবের সিনিয়র এএসপি খায়রুল ইসলাম তাদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানালে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

খায়রুল ইসলাম জানান, আদালতের নির্দেশনা মতে রিমান্ডে নেওয়ার সময় এবং রিমান্ড শেষে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিয়ম রয়েছে। নিয়মমতে রিমান্ডে যাদের নেওয়া হয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে যাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

জব্দ তালিকা দুটি করায় রামু থানার ওসির ব্যাখ্যা তলব আদালতের : মেজর সিনহার সহকর্মী শিপ্রা রানী দেবনাথের কাছ থেকে উদ্ধার করা মালপত্র নিয়ে কেন দুটি জব্দ তালিকা করা করা হয়েছে, আদালতে উপস্থিত হয়ে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য রামু থানার ওসি আবুল খায়েরকে আদেশ দিয়েছেন আদালত। কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (আদালত নম্বর-১) রামুর বিচারক হেলাল উদ্দিন ৭ কার্যদিবসের মধ্যে এর ব্যাখ্যা দিতে গত বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন।

৩১ জুলাই সিনহাকে হত্যার পর হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। রামু থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা দিয়ে কোর্টে চালান দেয়। শিপ্রাকে গ্রেপ্তারের সময় তার কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয় ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসসহ ২৯ আইটেমের সরঞ্জাম। মামলার জব্দ তালিকায় এসব সরঞ্জাম দেখানো হয়নি। তবে সেখান থেকে বিদেশি মদের ৪টি বোতল, ২ পোটলা গাঁজা ও কিছু মাদকদ্রব্য উদ্ধার করার দাবি করে তা তালিকাভুক্ত করা হয়। পরে রামু থানা পুলিশ পৃথক আর একটি জব্দ তালিকা তৈরি করে। শিপ্রার কক্ষ থেকে জব্দ ২৯টি মালপত্র রামু থানার এসআই শফিকুল ইসলামের হেফাজতে রাখেন।

রামু থানার মামলাটি তদন্তেরও দায়িত্ব দেওয়া হয় র‌্যাব-১৫কে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম রামু থানার জব্দ মালপত্র তার হেফাজতে আনার জন্য আদালতে আবেদন করেন। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার আদালতে শুনানিকালে রামু থানার পুলিশ শিপ্রার কাছ থেকে উদ্ধার মালপত্র তাদের হেফাজতে রাখতে এবং মামলাটি তাদের মাধ্যমে তদন্ত অব্যাহত রাখার অনুমতি দিতে আবেদন জানায়। আবেদন শুনানির সময় আদালত একটি মামলায় কেন দুটি জব্দ তালিকা করা হয়েছে তা জানতে চান। এ বিষয়ে রামু থানার পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আদেশ দেন।

আদেশে মামলায় কেন দুটি জব্দ তালিকা তৈরি করা হলো, তার আইনগত জবাব দিতে পরবর্তী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে ওসি আবুল খায়েরকে নির্দেশ দিয়েছেন। একই আদেশে শিপ্রা রানী দেবনাথকে গ্রেপ্তারের সময় তার কক্ষ থেকে উদ্ধার করা ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসসহ সব মালপত্র র‌্যাবকে হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেন। রামু থানার ওসি আবুল খায়ের জানিয়েছেন, আদালত তাকে তলব করা আদেশটি তিনি পেয়েছেন। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তিনি আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবেন। সমকাল

আরও খবর