১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টসহ বাংলার ইতিহাসে কলঙ্কিতময় কালো অধ্যায়ের সাক্ষী যে দিনগুলো ২০০৪ সালের ২১ আগস্টও তাদের মধ্যে একটি। দিনটি ছিল শনিবার। ঘড়ির কাটায় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। দুর্বৃত্তের গ্রেনেড হামলায় এদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা।
এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী আইভি রহমানসহ মারা যান ২৪ জন। এছাড়া আরো ৪শ’ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা:
সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে তুষার হত্যাকাণ্ড এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মী হত্যা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২০০৪ সালে এই দিনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও গণমিছিলের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। দিনটি ছিল শনিবার। সভা শুরু হয় বেলা সাড়ে ৩ টার দিকে। বিকেল পাঁচটায় দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন এবং ট্রাকে ওঠেন।
এ সময় ট্রাকে তার সঙ্গে ছিলেন জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ হানিফ ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আরো কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা-নেত্রী। ট্রাকের পাশেই নিচে ছিলেন ওবায়দুল কাদের, সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা-কর্মীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শেখ হাসিনা বক্তব্য শুরু করেন ৫টা ২ মিনিটে। ২১ মিনিট বক্তব্য দেয়ার পর ৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করে মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই দক্ষিণ দিক থেকে কে বা কারা তাকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে।
গ্রেনেডটি ট্রাকের বাম পাশে পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ হাসিনা ট্রাকের উপর বসে পড়েন। সঙ্গে থাকা অন্যান্য নেতারা এ সময় মানব দেয়ালের মতো চারিদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেন।
প্রথম গ্রেনেড হামলার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রাক লক্ষ্য করে একইদিক থেকে পরপর আরো দুটি গ্রেনেড ছোড়া হয়। এ সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা দেহরক্ষী পুলিশরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
এ অবস্থায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে তার মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেন। স্টেডিয়ামের দিক হয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়। শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছিলেন তখনো একইদিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে গ্রেনেড এসে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হতে থাকে।
এসব গুলি গ্রেনেড ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল তা বোঝা না গেলেও বেশ পরিকল্পিতভাবে যে হামলা হয়েছে তা পরে বোঝা যায়। পরে শেখ হাসিনার বাসভবন ধানমন্ডির সুধাসদনে গিয়ে তাকে বহনকারী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির সামনে পেছনে গ্রেনেড ও গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বিস্ফোরণের শব্দ আহতদের চিৎকার রক্তাক্ত নেতা-কর্মীদের ছুটোছুটিতে পুরো এলাকার চেহারা মুহূর্তের মধ্যেই পাল্টে যায়।
শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নেয়ার পর ট্রাক থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় নামতে থাকেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। যারা অচেতন হয়ে পড়েছিলেন তাদের ধরাধরি করে নামানো হয়। কি ঘটেছে কিছুই বুঝতে না পেরে অনেক নেতা-কর্মী এ সময় ছুটে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করেন। আহতদের মধ্যে অনেককে ধরে ভেতরে নেয়া হয়। অনেককে দেখা যায় রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটোছুটি করতে।
গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয় নেতা-কর্মীদের। রিকশা-ভ্যান অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
এ সময় অনেককে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাতে দেখা যায়। সন্ধ্যা ৬ টার দিকে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় পড়ে আছে জমাট বাঁধা রক্ত, হতাহতদের শরীর থেকে বের হয়ে থাকা নাড়িভুঁড়ি, রক্তাক্ত দলীয় পতাকা-ব্যানার আর পরিত্যক্ত স্যান্ডেল।
আহতদের দলীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকে বের করে ওঠানো হচ্ছিল ভ্যানে। উদ্ধারকারীরা ও আহতদের শরীর থেকে বের হওয়া রক্তে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। যার ফলে পাশে দাঁড়িয়ে ও শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না কে আহত আর কে উদ্ধারকর্মী।
উপস্থিত পুলিশ সদস্যের ভাষ্য, হামলাকারী যারাই হোক না কেন, তাদের টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা, এটি নিশ্চিত। এছাড়া হামলাটি চালানো হয়েছে দক্ষিণের সিটি ভবন অথবা পাশের পেট্রোল পাম্প থেকে।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরপরই ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধাসদনে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। ধীরে ধীরে সেখানে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা। ৬টার দিকে শেখ হাসিনা সুধাসদনে এসে পৌঁছায়। এর পরপরই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আসেন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, মতিয়া চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা।
এছাড়া আমির হোসেন আমু, মোহাম্মদ নাসিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, শেখ সেলিম, আব্দুর রাজ্জাক, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শেখ বজলুর রহমান, কাজী জাফরউল্লাহ, পংকজ দেবনাথ সহ শত শত নেতা-কর্মীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিভিন্ন জনকে সরকারি-বেসরকারি নানা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহ আলম মিন্টু। আজও শরীরে স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই দিন মহানগর ছাত্রলীগের উদ্যোগে জিরো পয়েন্ট থেকে মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধু ২৩ এভিনিউতে আসি। আমরা মিছিল নিয়ে নেত্রীর কাছে যেতেই একটি বোমা আমাদের সামনে এসে পড়ে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো নেত্রী যে ট্রাকে উঠেছেন, সেই ট্রাকের ট্রায়ার ব্লাস্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একের পর এক বোমা ফুটতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে পুরো জায়গাটা একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, সবাই যার যার মতো করে চিৎকার করছে। কেউ কাউকে সাহায্য করার মতো নেই। সবাই নিজের মতো করে চিৎকার-চেচামেচি করছে।
তিনি বলেন, কখন যে আমি মাটিতে পড়ে গেছি বলতে পারি না। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার শরীরের উপর দিয়ে হাজার হাজার মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে কোনো রকম উঠে দাঁড়ালাম। পরে দেখি সারা শরীরে রক্ত। বাম পা নাড়াতে পারছি না। তার কিছুক্ষণ পরে এক পরিচিত ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সেই প্রথমে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়।
চিকিৎসা শেষে আমরা যারা হামলায় আহত হয়েছিলাম সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং আমাকে ২০ হাজার টাকা চিকিৎসা খরচ দেন।
২১ আগস্টে সেই ভয়াবহ ঘটনায় শিকার অনেকেই এখনো পঙ্গু। কেউ কেউ বীভৎস সেই ঘটনার যন্ত্রণাময় ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে। কেউ চলৎশক্তিহীন। কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। অনেকের শরীরে রয়ে গেছে অসংখ্য স্প্লিন্টারের অস্তিত্ব। সব মিলিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা এখনো তাদের নিত্যসঙ্গী। বিদেশে গিয়ে সুচিকিৎসার সামর্থ্য নেই বেশিরভাগেরই।
সেদিনের ভয়াবহতার কথা মনে এলে আঁতকে ওঠেন এখনো তারা। সেদিনের দুঃস্বপ্ন প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে তাদের। অন্যদিকে প্রিয়জন হারানোর বেদনা বুকে চেপে বেঁচে আছেন গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্বজনরা। অনেক পরিবারে চলছে চরম দুর্দশা। মানবেতর জীবনযাপন এখন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
গ্রেনেড হামলার পর থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আর্থিক সহযোগিতাসহ নিয়মিত খোঁজ-খবর নিয়েছেন অসহায় পরিবারগুলোর। আহতদের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ট্রাস্টসহ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ফান্ডের মাধ্যমে নিহত ও আহতদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগানো হচ্ছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-