ওসি প্রদীপ, লিয়াকতসহ ৯ পুলিশের ভূমিকা যাচাই

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যায় তার পরিবারের দায়ের করা মামলার প্রধান তিন আসামি বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের প্রধান পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে রিমান্ড মঞ্জুরের ১২ দিনের মাথায় গতকাল মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে রিমান্ডে নিয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা র‌্যাব। এদিন কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কক্সবাজারের কারাগার থেকে তাদের র‌্যাবের হেফাজতে নেওয়া হয়।

এর আগে গত ৬ আগস্ট কক্সবাজারের আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকতসহ সাত পুলিশ সদস্য। পরে তাদের সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত। ওসি প্রদীপসহ তিনজনকে রিমান্ডে নেওয়ার মধ্য দিয়ে এখন মোট ১০ জন এ মামলায় র‌্যাবের হেফাজতে রয়েছেন। তাদের মধ্যে সাতজন পুলিশ ও তিনজন পুলিশের মামলার সাক্ষী। ওই তিন সাক্ষীকে পরে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এদিকে, সিনহা হত্যা মামলায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তারা হলেন কক্সবাজারের ১৪ এপিবিএনের উপপরিদর্শক শাহাজাহান, কনস্টেবল রাজিব ও আবদুল্লাহ। ঘটনার দিন তারা চেকপোস্টে ডিউটিতে ছিলেন।

র‌্যাবের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে জানান, সিনহা হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ৯ পুলিশ সদস্যের ভূমিকা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তারা সবাই চেকপোস্টে ছিলেন। তার মধ্যে তিন এপিবিএন সদস্য আগে থেকে চেকপোস্টে অবস্থান করছিলেন। সেখানে তারা দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ৯ পুলিশ সদস্যের ভূমিকা তারা সূক্ষ্ণভাবে বিশ্নেষণ করছেন। এতে সিনহা হত্যার ঘটনায় কে কী ধরনের রোল প্লে করেছেন, তা জানা যাবে। তদন্তে কেউ নিরপরাধ প্রমাণ হলে তাকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হবে। তদন্তে যার যার অপরাধ অনুযায়ী চার্জশিটে অভিযুক্ত করবেন তদন্ত কর্মকর্তা।

র‌্যাবের তদন্ত সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত যেসব প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য তারা পেয়েছেন তাতে উঠে এসেছে, প্রাইভেটকার থেকে বের হওয়ার সময় সিনহার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। কী পরিস্থিতিতে কেন গুলি করার মতো ঘটনা ঘটল, তা বের করা হচ্ছে। গুলি করার ঘটনা তাৎক্ষণিক, নাকি এটা পরিকল্পিত- সেটা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি র‌্যাব। এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রধান তিন আসামিসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঘটনার আলামত ও অন্যান্য তথ্য বিশ্নেষণ করেও প্রকৃত ঘটনা বের করার চেষ্টা হচ্ছে। কেন এক-দুটি গুলি কোমরের নিচে করা হলো, তা-ও বিশ্নেষণ করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ৩১ জানুয়ারি রাতে মেরিন ড্রাইভে কী ঘটেছে, তার পরিস্কার একটি চিত্র র‌্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা পেয়েছেন। এটি পরিকল্পিত, না তাৎক্ষণিক- সেটা নিশ্চিত হতে তদন্ত কর্মকর্তা আলামত ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য বিশ্নেষণ করছেন। এসব প্রক্রিয়া শেষে একটি গুণগত তদন্ত প্রতিবেদন যথাসময়ে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, সিনহা হত্যার ঘটনায় প্রধান তিন আসামি প্রদীপ, লিয়াকত ও নন্দ দুলাল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এ ঘটনা নিয়ে এত কিছু ঘটবে, তারা ধারণাও করতে পারেননি।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, মামলার প্রধান তিন আসামিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হবে ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত কিনা; না তাৎক্ষণিক সংঘটিত হয়েছে। কিংবা এর সঙ্গে আর কারা জড়িত রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের সামনাসামনি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার মোকাম্মেল হক জানিয়েছেন, গতকাল প্রধান তিন আসামি ছাড়াও এ পর্যন্ত ১০ জনকে রিমান্ডে নিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের সিনিয়র এএসপি খায়রুল ইসলাম।
এর আগে কারাগারে ওসি প্রদীপ কুমার, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে সোমবার দীর্ঘ সাড়ে সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত কমিটি। সেদিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের সিনিয়র এএসপি খায়রুল ইসলাম জানিয়েছেন, এপিবিএনের তিন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার হাজির হতে বলা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সিনহা হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহ হলে র‌্যাব তাদের গ্রেপ্তার করে। এ তিনজনকে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় র‌্যাব।

কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালত তাদের প্রত্যেকের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

টেকনাফ থানার সিসিটিভি ফুটেজ নেই :জানা গেছে, মামলার তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে আদালতের মাধ্যমে টেকনাফ থানার সিসিটিভি ফুটেজ চাওয়া হয়। সিসিটিভির যন্ত্রবিদ আলম নামের এক ব্যক্তি পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। সেখানে তিনি বলেন, টেকনাফ মডেল থানার ওসির নির্দেশে থানায় হাজির হয়ে ওসির কক্ষে সংরক্ষিত সিসিটিভি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করি।

এতে দেখা যায়, গত ২৫ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত ওসির রুমের কোনো সিসিটিভির ফুটেজ নেই। পূর্ব পাশের দেয়ালে সংরক্ষিত একটি এনভিআর বক্স পরীক্ষা করে কোনো হার্ডডিস্ক পাওয়া যায়নি। হার্ডডিস্ক না থাকায় কোনো ফুটেজও নেই। ওসির কক্ষের পশ্চিম পাশের সিসিটিভির হার্ডডিস্ক পাওয়া গেলেও নষ্ট থাকায় তার রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
সন্ধান মিলেছে ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্কের :সিনহা হত্যার পর হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে তল্লাশি করে রামু থানার পুলিশ। একজন পরিদর্শকের নেতৃত্বে ২০ জন পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। এর পর পুলিশ মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা দায়ের করে। শিপ্রা দেবনাথকে মামলায় একমাত্র আসামি দেখিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিসোর্ট থেকে কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক, ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায় পুলিশ। তবে পুলিশের দায়ের করা মামলায় যে জব্দ তালিকা করা হয়েছে, তাতে মাদকসহ ২৯টি আলামত দেখানো হলেও ল্যাপটপ, হার্ডডিস্ক ও মোবাইল ফোন জব্দ তালিকায় দেখানো হয়নি।

এ নিয়ে সিনহার সঙ্গী শিপ্রা অভিযোগ করেন, পুলিশ নীলিমা রিসোর্ট থেকে তাদের কয়েকটি হার্ডডিস্ক, মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ নিয়ে গেছে। এগুলো জব্দ তালিকায় না রেখে পুলিশ এখান থেকে তার ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করছে। তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য এমনটা করা হচ্ছে। এই নিয়ে গতকাল রাতে শিপ্রা কক্সবাজার থানায় মামলা করতে যান। তবে সেখানে মামলা না নিয়ে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা তাকে রামু থানায় মামলা করার পরামর্শ দেন।

অবশেষে এত দিন পর হদিস না পাওয়া এই হার্ডডিস্ক, মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ রামু থানায় রয়েছে বলে স্বীকার করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে রামু থানার ওসি আবুল খায়ের জানিয়েছেন, দুটি তালিকা করে এসব জিনিসপত্র থানায় রাখা হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা পাওয়া গেলে তা জমা দেওয়া হবে।

পুলিশের দায়ের করা মামলার জব্দ তালিকায় হার্ডডিস্ক, মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ দেখানো হয়নি কেন- জানতে চাইলে ওসি বলেন, মাদক মামলায় এগুলো দেখানো হয়নি। এগুলো ব্যক্তিগত সরঞ্জাম হিসেবে অন্য একটি তালিকা করে পৃথকভাবে রাখা হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও খবর