এখন অনুতাপে পুড়ছেন ওসি প্রদীপের সেই পরামর্শক আল্লাহ বকশ

চট্টগ্রাম প্রতিদিন ◑

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ হত্যার ঘটনা সামাল দিতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপকে পরামর্শ দেওয়া প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন সাবেক পুলিশ সুপার আল্লাহ বকশ চৌধুরী। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সাবেক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বর্তমান কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেওয়াকে বাহিনীর কার্যক্রমে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া উল্লেখ করে ওই ফোনালাপের প্রক্ষিতে সৃষ্ট সমালোচনার বিষয়েও নিজের অবস্থান ব্যাখা করেছেন সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা।

মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) সকালে নিজের বাসভবনে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে আলোচিত ওই ফোনালাপের বিষয়ে কথা বলেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম জেলার এই সভাপতি।

তিনি বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কর্মরত কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন এবং পরামর্শ চান। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ওইদিনও একইভাবে তৎকালীন ওসি টেকনাফ সেদিনের ঘটনা ও তার নেওয়া পদক্ষেপগুলো জানিয়েছিল। তার প্রেক্ষিতে আমি পরামর্শ দিয়েছি। তবে এখন বুঝতে পারছি মূল ঘটনার বিষয়ে অনেক কিছুই আমার কাছে গোপন করা হয়েছিল। এমনকি যাকে গুলি করা হয়েছে তিনি যে কমিশন্ড অফিসার, এটিও আমাকে জানানো হয়নি।’

আলোচিত সেই টেলিফোন আলাপে ‘অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসারদের প্রতি অবজ্ঞা করা হয়েছে’— বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা এমন অভিযোগের বিষয়ে পুরো ব্যাপারটিকেই ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ উল্লেখ করে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত এই পুলিশ কর্মকর্তা।

আল্লাহ বকশের ছোট ভাই খোদা বকশ চৌধুরী বিএনপি সরকারের আমলে পুলিশের শীর্ষপদ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি সাজা পান। দীর্ঘদিন কারাভোগ করে বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন।

পুলিশ সুপার হিসেবে ৬ বছর আগে অবসরে যাওয়া আল্লাহ বকশ বলেন, ‘পুলিশ ও আর্মির মধ্যকার কোন ঘটনায় চাকরিরতদের ক্ষেত্রে কিছু কাজের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবসরপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে সেই বিধিগুলো প্রযোজ্য নয়। আমি মূলত সেই বিষয়েই বলতে চেয়েছি। তা বলতে গিয়ে রিটায়ার্ড আর্মি শব্দ উচ্চারণে অবজ্ঞার সুর রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এটি একেবারেই স্লিপ অফ টাঙ। যার জন্য আমি মর্মাহত, অনুতপ্ত ও আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।’

প্রসঙ্গত পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃতুর পর একজন পদস্থ ব্যক্তির সাথে ফোনালাপের রেকর্ড ফাস হয়। ফাস হওয়া ওই রেকর্ডে ওসি প্রদীপকে এই ‘হত্যাকাণ্ড’ থেকে পরিত্রাণের উপায় বাতলে দেন ওই প্রান্তের ব্যক্তি। পরে জানা যায় প্রদীপকে পরামর্শ দেওয়া ওই ব্যক্তি সাবেক পুলিশ সুপার আল্লাহ বকশ চৌধুরী।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নে গ্রামের বাড়ি হলেও চট্টগ্রামের খুলশী মুরগির খামার এলাকায় নিজস্ব ভবনে বসবাস করছেন সাবেক এই এসপি।

নিহত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃত্যুর পর সাবেক পুলিশ সুপার আল্লাহ বকশ চৌধুরীর সঙ্গে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অডিও কথোপকথন ছিল এরকম—

আল্লাহ বকশ : হ্যালো।
ওসি প্রদীপ : স্যার, আদাব স্যার।
আল্লাহ বকশ : হ্যাঁ।
ওসি প্রদীপ : স্যার, আমি ওসি টেকনাফ প্রদীপ, স্যার।
আল্লাহ বকশ : হ্যাঁ কী খবর প্রদীপ, কোরবানির দিন গরুর মধ্যে তুমি কী!
ওসি প্রদীপ : স্যার, একটা মহাবিপদে পড়ছি, আপনার সাহায্য দরকার।
আল্লাহ বকশ : বলো বলো।
ওসি প্রদীপ : এখন আমরা স্যার একটা ১৫৩, ১৮৬ ও ৩০৭-এ মামলা নিছি স্যার।
আল্লাহ বকশ : ওয়ান ফিফটিথ্রি?
ওসি প্রদীপ : স্যার, থ্রি ফিফটিথ্রি।
আল্লাহ বকশ : থ্রি ফিফটি থ্রি সরকারি কর্মচারীর কাজে বাধা, আরেকটা হচ্ছে..
ওসি প্রদীপ : আরেকটা হচ্ছে ১৮৬- পুলিশের কাজে বাধা।
আল্লাহ বকশ : আর্মিদের ইন্টিমেশন দিছ কি না?
ওসি প্রদীপ : এরপরে দিছি স্যার আমরা। আর্মিরে জানাইছি। আর্মির লোকজন আসছে, সবাই আসছে।
আল্লাহ বকশ : এ কি আর্মির নাকি?
ওসি প্রদীপ : অবসরপ্রাপ্ত, স্যার ।
আল্লাহ বকশ : ও, তাইলে এত ডরের কী আছে?
ওসি প্রদীপ : এখন স্যার ও মারা গেছে, ইনজিওরড অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছে।
আল্লাহ বকশ : এর সঙ্গে যে লোকটা ছিল ওইটা কী?
ওসি প্রদীপ : ওইটা স্যার একটা ছাত্র, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির। সে বলছে যে আমরা রাতের বেলা পাহাড়ের সিন নেয়ার জন্য.. ওরা নাকি স্যার ইউটিউবের একটা চ্যানেল করার জন্য আসছে ভ্রমণের উপরে।
আল্লাহ বকশ : তোমরা তো অবস্ট্রাকশন দিছ, অবস্ট্রাকশন ভায়োলেট কইরা গেছে, গাড়ি চালাইছে।
গাড়িওয়ালারে এরেস্ট করছ কি না?
ওসি প্রদীপ : স্যার, গাড়িচালক তো ও নিজেই।
আল্লাহ বকশ : ও আচ্ছা আচ্ছা, গাড়ি জব্দ করছ কি না?
ওসি প্রদীপ : জি স্যার, করছি।
আল্লাহ বকশ : আচ্ছা তোমরা যে বাধা দিছ, ওভারটেক কইরা গেছে, এইটার সাক্ষী আছে কি না পাবলিক?
ওসি প্র দীপ : সাক্ষী আছে স্যার।
আল্লাহ বকশ : সাক্ষী থাকলে মামলা কী নিছ বলো।
ওসি প্রদীপ : মামলা নিছি স্যার ১৮৬, ৩৫৩, ৩০৭।
আল্লাহ বকশ : প্রেয়ার দিয়া দিবা যে একটা মার্ডার হইয়া গেছে।
ওসি প্রদীপ : আর আলাদা কোনো কেস দিতে হবে না স্যার?
আল্লাহ বকশ : আরেকটা কেস কী নিবা?
ওসি প্রদীপ : আরেকটা কেস আমরা কী নিব? ও যে সদর হাসপাতালে মারা গেছে স্যার। সদর হাসপাতালের বিষয়ে একটা ইউডি কেস নিয়ে নিব স্যার?
আল্লাহ বকশ : আমার তো মনে হয়, সদর থানারে দিয়া একটা ইউডি কেস করাইয়া রাখো।
ওসি প্রদীপ : ভালো হবে, না স্যার?
আল্লাহ বকশ : আমার মনে হয় ভালো হয়। আর্মির লোক তো পরে টানাটানি করে কি না!
আর নাইলে তো…
ওসি প্রদীপ : না হলে তো স্যার ওরা স্যার লাশ নিয়ে গেলে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে যেকোনো সময়। আমরা একটা মামলা করে ফেললে ওই মামলাটা ট্যাগ করা যাবে।
আল্লাহ বকশ : তাহলে তোমরা একটা কাজ করো না, ৩০৪-এ-ও একটা মামলা নিয়া নিতে পারো।
ওসি প্রদীপ : ৩০৪-এ আমরা কী লিখ স্যার?
আল্লাহ বকশ : লেখবা যে ইয়ার মধ্যে ইয়া হইছিল। আসামি হাউএভার মারা গেছে। এ কারণে মামলাটা রুজু করা হইলো। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
ওসি প্রদীপ : স্যার, ৩০৭-এ এখানে আসামির কলামে কী লিখব?
আল্লাহ বকশ : না, আরেকটা সেপারেট মামলার জন্য বলছি। যেহেতু আসামি মারা গেছে, তাই এ মৃত্যুর জন্য মামলা করা হলো।
ওসি প্রদীপ : স্যার, মামলা নিব যে আসামির কলামে নাম লিখতে হবে না?
আল্লাহ বকশ : পুলিশে গুলি করছিল, বুজছি তো। এই এজাহারটা পুরা লিখবা, যে এই এই কারণে তাকে অবস্ট্রাকশন করে আটকানো হইছিল। আটকানো হওয়ার পরে এই মামলা রজু হইছে। হাসপাতালে পাঠানোর পর সেখানে সে মারা গেছে। যেহেতু মানুষ মারা গেছে, তাই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মামলা রজু করা হলো, ৩০৪-এ।
ওসি প্রদীপ : আসামি অজ্ঞাত।
আল্লাহ বকশ : এইটা নিয়া রাখো। তাহলে এরা কোর্টে কেইস করলে এইটা ট্যাগ হইয়া যাবে।
ওসি প্রদীপ : স্যার, ৩০৪ আমি নিব নাকি সেখানে ডিউটি অফিসার দিয়ে নিয়ে রাখব সদর থানা দিয়ে?
আল্লাহ বকশ : সদর থানায় লইব নাকি তোমার মামলা?
ওসি প্রদীপ : সব কিছু লেখার পর লেখবো যে সদর থানার মধ্যে মারা গেছে, স্যার।
আল্লাহ বকশ : হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার এজাহারটা হুবহু লেইখা যাইবা, যে এই এই মামলার আসামি, তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হইয়াছিল। যেহেতু আসামি মারা গেছে হাসপাতালে, সেহেতু সে মারা গেছে হত্যা মামলা রুজু করা হলো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক। এই বর্ণনা হুবহু লেখবা।
ওসি প্রদীপ : সব কিছু লিখে লাস্টে এটা লিখব।
আল্লাহ বকশ : যেহেতু মারা গেছে, এসব ঘটনার কারণে ৩০৪-এ হত্যা মামলা রুজু করা হলো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
ওসি প্রদীপ : ঠিক আছে স্যার, আসসালামু আলাইকুম।
আল্লাহ বকশ : থ্যাংক ইউ।

আরও খবর