চকরিয়ায় ত্রাণ দেওয়ার নামে কোটি কোটি টাকা লুট : খোঁজ মিললো প্রতারক যুবলীগ নেতা মিজান

মুকুল কান্তি দাশ, চকরিয়া ◑

কক্সবাজারের চকরিয়ায় খোঁজ মিললো আরেক প্রতারক মিজান নামের এক যুবলীগ নেতার। মোবাইল ফোনে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছে মানুষের কোটি কোটি টাকা। এই টাকায় কিনেছে জমি, চিংড়িঘের, বাগান, দামি গাড়ি ও ফ্ল্যাট। কিনেছে প্লটও। প্রতারণার টাকায় ভাগিয়ে নিয়েছে ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পদকের পদ। অবৈধ টাকা ছিটিয়ে মাকে বানানো হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্যা।

প্রতারক চক্রটির প্রধান মোহাম্মদ মিজানুর রহমান চকরিয়া উপজেলা চিরিঙ্গা ইউনিয়নের ৪নম্বর ওয়ার্ডের জমির উদ্দিনের ছেলে।

সম্প্রতি বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। মো.মিজানুর রহমানকে চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর সে বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাইমচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম খান।

ওসি জহিরুল ইসলাম খান বলেন, ‘হাইমচর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এসএম কবিরের করা একটি মামলায় মিজানকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিজান অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। সেই সূত্র ধরে পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে। তাঁর অন্যতম সহযোগী নূর মানিক ও বাবুকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

বিকাশে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রটির প্রধান চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর ২৯ বছর বয়সী মিজানুর রহমান সম্পর্কে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এত অপরাধের জাল সারাদেশে বিছিয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকার হাতিয়ে নিলেও চকরিয়া থানায় নেই তার কোন তথ্য বা কোন অভিযোগ !

সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুর হাইমচর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এসএম কবিরের কাছ থেকে গত ১৪ মার্চ প্রতারক চক্রের সদস্য মিজান দুস্থ ও অসহায় গরিবদের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নাম ভাঙিয়ে আর্থিক অনুদান দেওয়ার আশ^াস দেন। পরে প্রাথমিক খরচ বাবদ প্রতারকের দেওয়া বিকাশে প্রেরণ করেন। চক্রটি হাইমচর উপজেলা থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ঘটনায় এসএম কবির বাদী হয়ে চলতি বছরের ১৯ মার্চ চাঁদপুর হাইমচর থানায় মামলা দায়ের করে। যার মামলা নম্বর: ৮।

অন্যদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে করোনাকালীন হতদরিদ্রদের ৭হাজার টাকার ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে প্রতিজনকে ত্রাণ সামগ্রী বাবদ ৭০০ টাকা করে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির নামে বিকাশে জমা দিতে বলেন। প্রতারকের চক্রের কথামতে শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মাইনুল ইসলাম ৭০জন হতদরিদ্রদের কাছে থেকে ৪৯ হাজার টাকা প্রতারকের দেওয়া বিকাশে প্রেরণ করেন।

পরে মাইনুলের অভিযোগের ভিত্তিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিবি পুলিশের একটি দল কুমিল্লা ডিবি পুলিশের সহায়তায় চলতি বছরের ৭ মে কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরশহর সোসাইটিপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিজানের প্রতারক চক্রের সদস্য মোবারক হোসেনের ছেলে ইফতেখার হোসেন সাহারুক গ্রেপ্তার করে।

এছাড়াও, ২০১৯সালের ৭সেপ্টেম্বর উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমকে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মকর্তা পরিচয়ে চকরিয়ার চরণদ্বীপের মৃত আবদুল করিমের ছেলে মোহাম্মদ নুর মানিক (৩৪) ফোন করেন। নুর মানিক মিজানুর রহমানের চক্রের অন্যতম সদস্য।

একইভাবে হতদরিদ্র মানুষের জন্য রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের নামে ২শত প্যাকেট ত্রাণ বরাদ্দের নাম করে প্যাকেট প্রতি খরচ বাবদ ৭০০ টাকা করে বিকাশের মাধ্যমে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়।

এছাড়াও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কামরুন নেছা বেবিকেও একইভাবে ১৫০প্যাকেট ত্রাণের প্যাকেট প্রতি ৭০০ টাকা বিকাশে টাকা পাঠাতে বলা হয়। দুইজন ভাইস চেয়ারম্যানকে বোকা বানিয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার হাতিয়ে নেন। পরে জাহাঙ্গীর আলম উখিয়া থানায় অভিযোগ দেন। অভিযোগ পেয়ে প্রতারণার মূল রহস্য উদ্ঘাটন ও প্রতারককে আটক করতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মানস বড়ুয়াকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

মানস বড়ুয়া প্রতারকদলের সদস্য নুর মানিককে গ্রেপ্তার করে। সারাদেশে চক্রটি মোবাইল ফোনে কৌশলে এমনভাবে রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতারণার সব কৌশলই রপ্ত করেছিলেন মো.মিজানুর রহমান।

জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের টার্গেট করে মোবাইল ফোনের সাহায্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফোন দিয়ে নিজেকে বিভিন্ন ‘দাতা সংস্থার’ লোক পরিচয় দিয়ে ত্রাণ দেওয়ার প্রস্তাব দিতো। পরে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতো। ৫ বছর আগে বেকার থাকা মিজানুর রহমান প্রতারণা করে কিনেছে কয়েক কোটি টাকার জমি।

চকরিয়া পৌরসভার মগবাজারস্থ আকবরিয়া পাড়ায় কোটি টাকা দামে ২০শতক জমি, চিরিঙ্গা ইউনিয়নের বুড়িপুকুর হেতারিয়াঘোনায় দুইশত শতক জমি কিনেছে। যার মূল্য প্রায় ১কোটি টাকা। ১৫০একর চিংড়িঘেরও বর্গা নিয়েছে। সেখানে ৬০লক্ষ টাকা বিনিযোগ করেছে। এসব সম্পত্তি প্রতারক মিজান নামে-বেনামে কিনেছে বলে জানায় স্থানীয়রা। প্রায় ২২লক্ষ ও ১৬লক্ষ টাকা দামে একটি কার ও নোয়া রয়েছে। একটি দামি মডেলের মোটরসাইকেলও আছে। এছাড়াও বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় বাগান রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, ‘প্রতারক’ মিজানুর রহমান অল্প দিনের মধ্যে নিজেকে বদলে নিয়েছে। নিজ এলাকা চিরিঙ্গা ইউনিয়নের দক্ষিণ বুড়িপুকুর এলাকায় প্রায় ৭০লক্ষ ব্যয়ে নির্মাণ করেছে আলিশান বাড়ি। নিজে চড়েন দামি গাড়ি নিয়ে। আলীকদমে শ^শুর বাড়ি রয়েছে তার সম্পদের কিছু অংশ। সব কিছুই কিনেছে মোবাইল ফোনে মানুষকে প্রতারিত করে।

মিজান ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের পদবী কিনে নেন বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে। তাঁর বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একাধিকবার অভিযান চালালেও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এসব অপকর্মের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। তাঁর অন্যতম সহযোগী নূর মানিক ও বাবু মানিক গ্রেপ্তারের পর গা ডাকা দিয়েছে।

হাইমচর থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক সুজন কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘একজন সাবেক জনপ্রতিনিধির মামলার ভিত্তিতে ৩০জুলাই তাকে আলীকদম উপজেলার একটি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতারণার কাছে ব্যবহারিত মোবাইল, সিম উদ্ধার করা হয়েছে। এবিষয়ে তদন্ত চলছে।’

চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মিজানুর রহমান নামের যুবকটি বড় ধরনের প্রতারক। সেই হাইমচরের গ্রেপ্তারের পর জানতে পারি তাঁর বিরুদ্ধে উখিয়া, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন থানায় মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। তাঁর প্রতারক চক্রের অন্য সদস্যদের ধরতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।

আরও খবর