মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলা

টেকনাফে শুদ্ধি অভিযান

সমকাল ◑

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে টেকনাফ থানার পুলিশ প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন আসছে। শুরু হয়েছে শুদ্ধি অভিযান। আজকালের মধ্যে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের স্থলে নতুন ওসি যোগদান করছেন। তার নাম মো. ফয়সাল। কুমিল্লা থেকে বদলি হয়ে যাচ্ছেন তিনি। নতুন ওসির যোগদানের পরপরই থানার প্রায় সব পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হবে।

কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদে ৬০-৭০ পুলিশ সদস্য টেকনাফ থানায় রয়েছেন। পুরোনো কোনো স্টাফকে সেখানে আর না রাখার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঊর্ধ্বতনরা। সেখানকার অনেকের বিরুদ্ধে ছোট-বড় অভিযোগ রয়েছে। আবার কেউ কেউ ওসি প্রদীপের বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে বেআইনি কর্মকাণ্ডেও জড়িয়েছেন। এমন বাস্তবতায় নতুন জনবল কাঠামো দিয়েই আগামীতে টেকনাফ থানা চালানো হবে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র গতকাল এ তথ্য জানায়।

এদিকে সিনহা হত্যা মামলায় গতকাল শনিবার পুলিশের চার সদস্যকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা। আজ রোববার থেকে প্রদীপসহ সাত আসামিকে পর্যায়ক্রমে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে র‌্যাব।

জানতে চাইলে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, জেলগেটে কয়েকজনকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রোববার থেকে সাতজনকে পর্যায়ে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, মামলার আলামত নিজেদের হেফাজতে নিতে আজকালের মধ্যে আদালতে আবেদন করবে র‌্যাব। মামলার তদন্তে জব্দ আলামতের গুরুত্ব অনেক।

কক্সবাজার জেলা কারাগারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে সিনহা হত্যা মামলার রিমান্ডের আদেশপ্রাপ্ত ৭ আসামির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নথিপত্র জেলা কারাগারে পৌঁছেছে।

দুই আসামির নাম নিয়ে বিভ্রান্তি : সিনহা নিহতের ঘটনায় তার বোন বাদী হয়ে কক্সবাজার আদালতে যে মামলা করেন তাতে মোট ৯ জনকে আসামি করা হয়েছিল। ওই মামলায় বৃহস্পতিবার ওসি প্রদীপসহ সাতজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর শুনানি শেষে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তবে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা নামে দু’জন আদালতে হাজির হননি। পরে তাদের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে একাধিক সংস্থা। গতকাল পর্যন্ত ওই নামে দুই আসামির ব্যাপারে কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, টুটুল নামে কোনো সদস্য কক্সবাজার জেলা পুলিশে কর্মরত নেই। আর মোস্তফা নামে কোনো পুলিশ সদস্য টেকনাফের বাহারছড়া ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন না। হয়তো ভুল করে মামলায় এই দুটি নাম এসেছে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার পর ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাকে ফোন করেছিল। তখন তিনি একটি প্রোগ্রামে ছিলেন। তাদের সঙ্গে কথপোকথনের যে অডিও প্রকাশ ও প্রচার হচ্ছে এটা খণ্ডিত অংশ। আগে ও পরে তাদের সঙ্গে আরও অনেক কথা ছিল। কাউকে তিনি কিছু শিখিয়ে দেননি। এটা নিয়ে আর কথা বলতে চান না। তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা সব সত্য বের করবে।

ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে সিনহার সঙ্গে কক্সবাজার যান স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথসহ ৩ জন। শিপ্রার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে রামু থানায় মামলা করে পুলিশ। সেখানে বলা হয়, আহত সিনহা মো. রাশেদ ও তার সঙ্গীকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান যে হিমছড়িতে তাদের ভাড়া করা নীলিমা রিসোর্টে অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। পরে সেই কক্ষে অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি মদ, গাঁজাসহ শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

টেকনাফ থানার আরেক মামলার এজাহারে বলা হয়, চেকপোস্টে পুলিশ সিনহার প্রাইভেটকার থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে সংকেত না মেনে অতিক্রম করার চেষ্টা করে গাড়িটি। গাড়ির চালকের আসনে বসা এক ব্যক্তি তর্ক শুরু করেন। তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে প্রাইভেটকারের ড্রাইভিং সিটে বসা ব্যক্তি নেমে নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দেন। এরপর তাকে হাত উঁচু করে দাঁড়াতে বলেন ও তার বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। ওই ব্যক্তি কিছু সময় তর্ক করে তার কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে গুরুতর আহত হন। পরে তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

শিপ্রা ও সিফাতের মুক্তির দাবিতে গত কয়েক দিন ধরে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন তাদের সহপাঠীরা। তাদের পরিবারও বলছে, তাদের সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলায় আনা অভিযোগ সঠিক নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র শিপ্রাকে আইনি সহযোগিতা দেবে।

প্রদীপের দুই আস্থাভাজন বদলি : জানা গেছে, প্রদীপের অনেক অপকর্মের সঙ্গী ছিলেন এএসআই মিঠুন ভৌমিক ও এএসআই সঞ্জীব দত্ত। এরই মধ্যে মিঠুনকে কক্সবাজার ডিএসবিতে ও সঞ্জীবকে পেকুয়া থানায় বদলি করা হয়েছে। প্রদীপের হয়ে মিঠুন ও সঞ্জীব অনেক নিরীহ মানুষকে ধরে এনে টাকা আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টাকা না দিলে নির্যাতন করা হতো। টাকা আদায় করার পরও মাদকসহ মামলা দিয়ে চালান দেওয়া হতো। পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাষ্য- অনেক সময় ভালো পুলিশ সদস্যরা টেকনাফে যেতে চায় না। তাদের আশঙ্কা থাকে, মাদক রাজ্যে তারা কোনো না কোনোভাবে ফেঁসে যেতে পারেন।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, প্রদীপের অপকর্মের সঙ্গীরা যত দ্রুত টেকনাফ ছাড়বে ততই এলাকাবাসীর মঙ্গল। ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করার নামে নিরীহ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

আরও খবর