মানবজমিন ◑
সিনহা মো. রাশেদ খান। পরিবারের সবাই ডাকতো আদনান। মায়ের আদরের বাবু। ছিলেন একটি গোছানো পরিবারের ইতিবাচক সব চিন্তার উৎস। চেষ্টা করতেন প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকতে। তাই ভ্রমণ হয়ে উঠেছিল তার নেশার বিষয়। শিক্ষাজীবনে কৃতিত্ব দেখানো সিনহা সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দেশ সেবার ব্রত নিয়ে শুরু করেছিলেন
কর্মজীবন। প্রায় দেড় যুগ চাকরি করেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এই সময়ে। সেনাজীবনে বড় কোনো অর্জনের আরো চাওয়া হয়তো ছিল না। তাই জীবন নিয়ে ভিন্ন চিন্তা শুরু করেছিলেন। ভ্রমণ আর নতুন কিছু করার চিন্তায় চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। শুরু করেছিলেন নিজের মতো পথ চলা। কিন্তু নির্মম এক হত্যাকাণ্ড সিনহার এ পথ চলা চিরতরে থামিয়ে দিয়েছে। পরিবারের সবার প্রিয় এই মানুষটির নানা স্মৃৃতি এখন স্বজনদের মুখে মুখে। বন্ধু স্বজনরাও করছেন স্মৃতিচারণ।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে সিনহা ছিলেন মেজো। ১৯৮৪ সালে কর্নফূলীর চন্দ্রঘোণায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কুর্মিটোলার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এসএসসি এবং রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় বোন শারমিন শাহরিয়া একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আর ছোট বোন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। অল্পবয়স থেকেই ছিল সিনহার অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। ছিলেন বিতার্কিক। স্কুলে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে। খেলাধুলা ও বইপড়া দু’টোই ছিল তার প্রিয়। সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে মানবজমিনকে বলেন, আদনান আমাকে ছোট বেলায় দুষ্টুমি করে শ্যাম্পু বলে ডাকতো। মাকে ডাকতো মাওরি বলে। একটি গানও বানিয়েছে মাকে নিয়ে ‘মাওরি কি মাওরি ডিং ডিং।’ আমাদের পরিবারের সুন্দর একটি পরিচিতি আছে ‘ওয়ান্ডারফুল ফ্যামিলি।’ আদনান ছিল সেই ওয়ান্ডারফুল ফ্যামিলির ওয়ান্ডার মেম্বার। সে ছিল আমাদের সবার শক্তি এবং উৎসাহের জায়গা। সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করতো। নেতিবাচক চিন্তা, কাজকর্ম এবং হতাশা থেকে দূরে থাকতো। এ বিষয়গুলো কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার ছিল জ্ঞান আহরণের প্রতি অসীম আকাঙ্ক্ষা। আদনান সব সময়ই আমাদের বলতো ‘তোমরা জ্ঞান আহরণ করো, দেখবে সব ছোট ছোট বিষয়গুলোর ঊর্ধ্বে উঠে যাবে’। ও যেখানেই যেত সঙ্গে একটি বই থাকতো। মানুষের প্রতি রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা এসব কিছুই ছিল না তার।
শারমিন শাহরিয়া বলেন, আদনান প্রায়শই বলতো ‘ফরগেট এন্ড ফরগিভ’। ও প্রকৃতিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো। প্রকৃতি, পশু-পাখি, ফুল-গুল্ম ছিল তার ভালোবাসার জায়গা। ছিল অত্যন্ত ভ্রমণপ্রেমী। সুযোগ পেলেই ভ্রমণে বেড়িয়ে যেতো। শারমিন বলেন, আদনান আমার ৫ বছরের ছোট। যেকোনো বিষয়ে আমরা ওর পরামর্শই নিতাম। ২০০৭ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর ওই জায়গাটা আদনানই নিয়েছিল। ৫১ বিএমএ লং কোর্সে অংশ নিয়ে সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া সিনহা ২০১৮ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাসে থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসরে যান। ও যখন চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল, তার দুই বছর পর অনুমতি মিলেছিল। তারা আদনানকে ছাড়তে চাচ্ছিল না। মায়ের কাছেও তারা অনুরোধ করেছিল, যেন ছেলেকে তিনি বোঝান। আদনান তাদের বলেছিল, সেনাবাহিনীতে ১৭/১৮ বছর চাকরি করে যেটুকু শেখার সে শিখেছে। এখন নতুন কিছু করার চিন্তা আছে তার।
শাহরিয়া বলেন, বিশ্বভ্রমণ ছিল তার ছোটবেলার স্বপ্ন। সেজন্য ২৫ কেজি ওজনের ব্যাকপ্যাকটাও রেডি করে রেখেছিল। সাইক্লিংয়ের যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সবকিছু ছিল সেখানে। কথা ছিল, এ বছরই চীন থেকে ওর বিশ্বভ্রমণ শুরু হবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তা আর হয়নি। পরে সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময় যখনই সুযোগ হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। তিনি বলেন, ও ছিল হাসিখুশি। ইচ্ছা ছিল নিজের বিশ্ব ভ্রমণের সব খুঁটিনাটি প্রকাশ করবে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে। এর মধ্যে রাজশাহী গিয়ে চার মাস ছিল। উদ্দেশ্য সেখানে তার এক বন্ধুর মায়ের গড়ে তোলা লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে নিজেকে বিশ্বভ্রমণের জন্য আরো তৈরি করা।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয়ে যাওয়ায় তার পরিকল্পনা থমকে যায়। তখন ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর পরিকল্পনা করেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। কক্সবাজারের হিমছড়িতে সেই ডকুমেন্টারির কাজই তিনি করছিলেন বলে জানান শারমিন। সর্বত্রই থাকার প্রস্তুতি ছিল তার। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে আদনান আমাদেরকে বলতো আমি হিমালয়ে যাবো। এজন্য সে আম্মুর কাছে প্রতিদিন দুই টাকার পান বিক্রি করে টাকা জমাতো। বলতো, এই টাকা দিয়ে আমি হিমালয়ে যাবো। এতটুকুন বয়স থেকেই তার চিন্তা-ভাবনা-কল্পনা সর্বত্রই ছিল অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। সব সময় নিজেকে সেই হিসেবে প্রস্তুত করেছে। সেনাবাহিনীতে যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দেশ সেবা। সে মাকে বলতো, ‘মা আমি তোমার নয়, জাতির সন্তান, দেশের সন্তান।’
শারমিন শাহরিয়া বলেন, এস এস এফ-এ অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে আদনান। রাজশাহীতে ফোর্স ইন্সট্রাক্টর হিসেবে সুনাম এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে। প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রেও। আন্তঃবাহিনীর বেয়নেট ফাইটিং, প্রতিযোগিতা এবং শুটিংসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিনহার বোন বলেন, আদনান ছিল স্বাধীনচেতা, ন্যায়পরায়ণ, দয়ালু ও মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। কঠিন বিষয়কেও নিজগুণে সহজ করে ফেলতো। শিক্ষক, বন্ধু, আত্মীয়-পরিজন এমনকি মুহূর্তের পরিচিত মানুষকেও আপন করে নেয়ার অসাধারণ গুণ ছিল তার। সকলের ভালোবাসার পাত্র ছিল। পরিবারের প্রতি ছিল তার অগাধ দায়িত্ববোধ।
ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে শাহরিয়া বলেন, কোথাও নিজের আত্মপ্রচার করতো না আদনান। ছিল খুবই বিনয়ী। তার লেখালেখিরও অভ্যাস ছিল। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন ২৬শে মার্চ নিয়ে কবিতা লিখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
সিনহা মো. রাশেদ খানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে হলেও বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ খানের সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় থাকতে হয়েছে। সবশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ছিলেন এরশাদ খান। বাবার মৃত্যুর পর মা নাসিমা আক্তারকে নিয়ে থাকতেন সিনহা।
গত ৩১শে আগস্ট কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ এলাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যান অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান।
এ ঘটনায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ দাসসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা করেছেন সিনহার বোন। এ মামলায় প্রদীপসহ তিন আসামিকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে র্যাব। বাকি চার আসামি কারাগারে আছেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-