করোনামহামারির বাস্তবতায় পুরোপুরি অচেনারূপে, সীমিত পরিসরে শুরু হওয়া পবিত্র হজের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। আধুনিক সৌদি ইতিহাসতো বটেই, স্মরণকালের ইতিহাসে এবারের মতো এত কম মানুষ আর হজ করেনি।
রোববার (২ আগস্ট) সৌদি আরবের স্থানীয় হিসাবমতে ১২ জিলহজ। এদিন হজের অন্যতম আমল ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে পাথর মারতে হয়। এটা ওয়াজিব আমল। এই আমল শেষে হাজিরা মিনা ত্যাগ করে মক্কা পৌঁছেছেন। মক্কায় তারা বিদায়ী তাওয়াফ সম্পন্ন করে হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এবার সীমিত মানুষের অংশগ্রহণে হজের আয়োজন করা হয়। মোট কতজন হজযাত্রী এবারের হজের অংশ নিয়েছেন সেটা এখনও সৌদি কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতিতে ১৬০ দেশের মাত্র ১০ হাজার মানুষ এবার হজপালনের সুযোগ পেয়েছেন। শুধু সৌদি আরবে বসবাসকারী বিভিন্ন দেশের অধিবাসী ও স্থানীয় নাগরিকরা হজের জন্য নির্বাচিত হন। মোট হজযাত্রীর ৭০ শতাংশ সৌদি আরবে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের প্রবাসী।
যেহেতু এবার ভিন্ন পরিস্থিতিতে হজের আয়োজন করা হয়েছে, তাই এবার হাজিরা মদিনায় যাবেন কিনা, সেটা স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়নি। মদিনা না গেলে হাজিরা নিজ নিজ বাড়ি ফিরবেন এবং সেখানে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন সম্পন্ন করবেন। এর আগে আরেক দফা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে সবাইকে।
হজের বিধানে বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব। মিকাতের বাইরে যেসব হাজিরা এসেছেন, তাদের জন্য মক্কা মোকাররমা ত্যাগ করার সময় বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয়। আর যারা মক্কা এলাকার ভেতরে থাকেন, তাদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ মোস্তাহাব। বিদায়ী তাওয়াফে কোনো রমল, ইজতেবা ও সায়ি নেই। শুধু কাবাকে সাত চক্করে তাওয়াফ করে ও দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। নামাজ শেষে খুব অনুনয়-বিনয় করে চোখের পানি ছেড়ে দোয়া করতে হয়।
হানাফি মাজহাবে বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব। এটা ছুটে গেলে দম দিতে হবে। হাদিসে আছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কাবাঘরে বিদায়ী তাওয়াফ করা ছাড়া যেন কেউ দেশে ফিরে না যায়।’ –সহিহ মুসলিম: ১৩২৭
অবশ্য কোনো কোনো মাজহাবে এটাকে হজের বহির্ভূত পৃথক ইবাদত হিসেবে পালন করা হয়। তাদের মতে মক্কাবাসী বা মক্কায় অবস্থানরত ভিনদেশি এবং বহিরাগত লোকেরা মক্কা থেকে সফরে বের হলে বিদায়ী তাওয়াফ করা লাগবে এবং এটা বছরের যেকোনো সময়েই হোক না কেন।
রোববার (২ আগস্ট) আসরের নামাজের আগে দলবেঁধে হাজিরা কাবা চত্বরে প্রবেশ করে বিদায়ী তাওয়াফ করেন। এর পর সেখানে নফল ইবাদত-বন্দেগিতে সময় কাটান।
সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তাওয়াফের সম্প্রচারে দেখা গেছে, সবার চোখে বিরহের অশ্রু। অনেককে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে মোনাজাত করতেও দেখা গেছে। হজ কবুল, পাপ মুক্তিসহ বিভিন্ন ফরিয়াদ জানিয়ে দোয়া করেছেন হাজিরা।
এর আগে নজিরবিহীন স্বাস্থ্যবিধি সুরক্ষা ও সৃশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে ২৯ জুলাই সকাল থেকে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে এই প্রথম সৌদি সরকার হজে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
সৌদি আরবের জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ জারি বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি। এবার কোনো হাজি কাবা শরিফে ও কালো পাথরে চুমু খেতে বা স্পর্শ করেননি। হাজি ও হজে দায়িত্ব পালনকারীরা সারাক্ষণ মাস্ক ব্যবহারসহ অন্তত দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। এসব নিয়ম মেনে হজের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছেন।
কাবার তাওয়াফ, আরাফার ময়দানে অবস্থান, মুজদালিফায় রাতযাপন ও মিনায় পাথর নিক্ষেপ থেকে শুরু করে সব কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে, নিরাপদে, সুরক্ষিত অবস্থায় এবং প্রশান্তির সঙ্গে পালন করেছেন।
এদিকে শনিবার (১ আগস্ট) দেশটির সহকারী স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডা. মুহাম্মদ আল আবদালি জানিয়েছেন, এখন (শনিবার) পর্যন্ত হাজিদের করোনায় আক্রান্তের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
হাজিদের সেবায় ১৮ হাজার ৪৯০ জন কর্মী নিয়োগ নিয়োজিত ছিল। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য নিয়োজিত ছিল আরও ১৩ হাজার ৫০০ জন।
চলতি বছর হজে অংশগ্রহণকারীদের স্বাস্থ্য পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন ডা. আমানি আল সাদি।
তিনি বলেন, সর্বদা হাজিদের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তাদের পরস্পরে যোগাযোগের সুযোগ সীমিত করা হয়েছিল। বাসে যাতায়াতের সময় আসনগুলো পূর্ব নির্ধারিত ছিল। প্রত্যেক আবাসিক কমপ্লেক্সে একটি করে সুসজ্জিত অত্যাধুনিক ক্লিনিক ছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় কোনো সমস্যা হয়নি।
এবার হজপালনের সুযোগ পাওয়াদের মধ্যে ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার ফরিদা। তিনি বলেন, হজের জন্য নির্বাচিত হওয়াটাই ‘অবিশ্বাস্য এবং অতুলনীয়’ এক ব্যাপার। এটা ছিল আমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আশীর্বাদ। আজীবন আমি খোদার প্রতি সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে আমার দায়িত্ব পালন করে যাব।
হজের আয়োজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ রকম সুন্দর একটি আয়োজনের জন্য সৌদি আরবকে ধন্যবাদ দিতে হবে। আমার কোনো সময় শঙ্কিত হইনি। তবে হ্যাঁ, কাবা চত্ত্বরে থাকার, কাবার দেখার তৃপ্তি মেটেনি।
এবারের হজে বেশকিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে। যদিও এসবের কারণে হজে কোনো ত্রুটি হয়নি। এবারের হজে ইতিহাসের প্রথমবারের মতো একটিমাত্র মিকাত ‘কারন আল মানাজিল’ (ইহরাম পরিধানের সর্বশেষ নির্ধারিত স্থান) ব্যবহার করা হয়। সীমিত পরিসরে তাওয়াফ করতে হয়েছে, নফল তাওয়াফ করার সুযোগ পাননি। হাজিদের মিনায় তাঁবুতে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। নির্ধারিত ভবনে অবস্থান করতে হয়েছে। মুজদালিফা ও আরাফাতের ময়দানে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। কোনো হাজি এ বছর নিজে কোরবানির পশু ক্রয় ও জবাই করেননি। নির্ধারিত ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে কোনো হাজিকে নিজস্ব জিনিসপত্র ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। সৌদি আরবের হজ ও উমরা মন্ত্রণালয় নিবন্ধিত হজযাত্রীদের প্রয়োজনীয় যেসব সামগ্রী সরবরাহ করেছেন, শুধুমাত্র সেগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে। এবার বাইরের কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণের অনুমতি ছিলো না। সৌদি সরকার হাজিদের সব খাবার ও পানীয় সরবরাহ করছে। হাজিদের যাতায়াত করতে হয়েছে নির্ধারিত বাসে। প্রতি ২০ হাজির জন্য একটি বাস নির্ধারণ করা হয়েছিল।
রীতি অনুযায়ী ৯ জিলহজ, হজের দিন কাবার গিলাফ না বদলে ৮ জিলহজ রাতে এশার নামাজের পর গিলাফ বদলানো হয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-