ইয়াবা বান্ধব ইউনিয়ন উখিয়ার পালংখালী!

রফিকুল ইসলাম ◑
দশ হাজার পিস মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে গত ১৩ জুলাই রাতে র‌্যাব- ১৫ সদস্যদের হাতে গ্রেফতার হন নুরুল আবছার চৌধুরী। সাথে তার এক সহযোগী। নুরুল আবছার চৌধুরী কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নং বালুখালী ওয়ার্ডের মেম্বার।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের উখিয়া উপজেলা কমিটির সভাপতি, উখিয়া যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বালুখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানজিং কমিটির সভাপতিসহ আরও অনেক পদনাশীন। ইতিপূর্বে ২০১৬ সালের শেষের দিকে বালুখালীস্হ তার অফিস থেকে কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিল।

একই ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড মেম্বার বকতিয়ার আহামদ ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রথম নির্বাচিত হন। মেম্বার হিসেবে শপথ গ্রহনের পরদিন ৫০ হাজার ইয়াবা নিয়ে ঢাকার খিলখেত থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের বিচারকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে কথিত জামিনে এসে ঘুরতে থাকেন। কিছুদিন পর ঘটনা জানাজানি হলে সে আত্মগোপনে চলে যায়। পরবর্তীতে আটক হয়ে ফের জেলে যান। সম্প্রতি কয়েকমাস আগে হাইকোর্ট থেকে জামিনে এসে এলাকায় বীরদর্পে আগের কুকর্ম চালানোর অভিযোগ উঠেছে।

ঐ ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড মেম্বার জয়নাল আবেদীন গতবছর কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে ইয়াবা নিয়ে কথিত বান্ধবীসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। সে এখনও জেলে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ অনেকদিনের। কক্সবাজার ডিবি পুলিশের ১০ লক্ষ পিস ইয়াবা কেলেঙ্কারির ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার কথা উঠে এসেছে একাধিকবার।

৫ নং ওয়ার্ড মেম্বার নুরুল আমিনও একজন বড় ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত। তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য, বৌদ্ধ মন্দিরে হামলাসহ একাধিক গুরুতর মামলা রয়েছে। ২০১৭ সালে আগষ্টে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা আগমনের সময় সেও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা তার বাড়ী সংলগ্ন হাকিমপাড়ায় রোহিঙ্গাদের এনে ক্যাম্প স্হাপন করে। সে বর্তমানে আত্মগোপনে থেকে রোহিঙ্গাদের সাথে মিলেমিশে ইয়াবা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

৬ নং ওয়ার্ড মেম্বার তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধেও ইয়াবা ব্যবসা ও ইয়াবা পাচারের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। সেও বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছে। তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। ৭ নং ওয়ার্ড মেম্বার নুরুল হকের এর বিরুদ্ধেও ইয়াবাসহ বেআইনী কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। কয়েকমাস পূর্বে তিনি ইয়াবা মামলায় জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

৮ নং ওয়ার্ড মেম্বার কামাল উদ্দিন ও তার নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। সেও অনেকটা আত্মগোপনে রয়েছেন। মাদকদ্রব্য ব্যবসা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, ভাংচুরসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সর্বশেষ ৯ নং ওয়ার্ড মেম্বার সোলতান আহমদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র, ডাকাতিসহ একাধিক গুরুতর মামলা রয়েছে। সে অবশ্য সবকটি মামলায় জামিনে রয়েছেন বলে জানা যায়। মেম্বার ছাড়াও ঐ ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড চকিদার জুনুও কয়েকমাস আগে ১০ হাজার ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে আটক হয়ে জেলে রয়েছেন।

উক্ত ইউনিয়নের ৯ জন ওয়ার্ড মেম্বারের মধ্যে একমাত্র ৪ নং ওয়ার্ড মেম্বার মোজাফ্ফর আহমেদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসা বা পাচারের অভিযোগ পাওয়া যায় নি। ঐ ইউনিয়নের ৩ জন সংরক্ষিত মহিলা মেম্বারের মধ্যে এক মহিলা মেম্বারের স্বামীর বিরুদ্ধেও ইয়াবা সেবনের অভিযোগ রয়েছে। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের অভিযুক্ত ওয়ার্ড মেম্বার ও তাদের পরিবারের অবশ্য এসব অভিযোগ প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র বলে দাবী করছেন।

পুরো পালংখালী ইউনিয়নে উখিয়ার ২১ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে ১৩ টির অবস্থান। রয়েছে বিস্তীর্ণ ইউনিয়ন জুড়ে পূর্ব পাশ নাফনদীর ওপাড়ে মিয়ানমারের সাথে জলজ সীমান্ত। নদী সীমান্ত থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর দূরত্ব দেড় দুই কিলোমিটারের মধ্যে। এ সীমানা ব্যবহার করে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে প্রায় প্রতিরাতে ইয়াবার চালান পাচার করতে রোহিঙ্গাদের নিয়মিত মিয়ানমার যাতায়াত রয়েছে বলে পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান।

পালংখালী ইউনিয়নের ৯ জন সাধারণ মেম্বারের মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সাথে ইয়াবা ব্যবসা ও পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

এ ব্যাপারে পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষের দিকে, কিন্তু মেম্বারদের অনাকাংখিত অনুপস্থিতিতে জনগণের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে। সরকারী, বেসরকারী বিভিন্ন উন্নয়ন, উপকার ভোগীদের তালিকা প্রণয়ন, নানাবিধ ত্রাণ, নগদ অর্থ বিতরণসহ কোনকিছুই স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না।

তিনি বলেন, পালংখালী ইউনিয়নের আওতায় ১৩ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত ৮ লক্ষ রোহিঙ্গার বসবাস। সবকিছু মিলিয়ে এলাকার শান্তি শৃংখলা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে অতীতের চেয়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে ইয়াবা পাচার ও ব্যবসা। তার উপর আমার ইউনিয়ন পরিষদের ৯ জন পুরুষ মেম্বারের মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে ইয়াবা সংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে। কেউ জেলে বা কেউ আত্মগোপনে থাকায় পরিষদের দৈনন্দিন কর্মকান্ড চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে ও জনগণকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৯ জন পুরুষ মেম্বারের মধ্যে অধিকাংশের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য ব্যবসা ও পাচার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে ৪ জন মেম্বার আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ আটক হয়ে জেল খাটে। যারা জামিনে আসছে তারাসহ আরও বেশ কয়েকজন আত্মগোপনে রয়েছেন। পুলিশ ওদের ব্যাপারে তদন্ত করছে। মাদকের সঙ্গে নুন্যতম সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিললে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে তিনি জানান।

আরও খবর