উখিয়ার সোনাইছড়ির ঘটনা নিরপেক্ষ তদন্তের জোর দাবী

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী ◑

উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের পশ্চিম সোনাইছড়ির বাদামতলী এলাকা। গত ৮ জুন বিকেল ৫ টা ২০ মিনিটের দিকে স্থানীয় সুপারী ব্যবসায়ী সোলতান আহমদ (৬০) ও একই এলাকার মৃত বজল আহমদ এর পুত্র আনছার উল্লাহ (৩০) এর সাথে সুপারি বিক্রির বকেয়া টাকার লেনদেন নিয়ে ২ জনের মধ্যে কথা কথাকাটি হয়। পরে দুইজনই উত্তেজিত হয়ে মারামারি দিলে সেখানে দোকানে আগে থেকেই অবস্থানরত লোকজন তাদের আলাদা করে দুইজনকে দুই দিকে সরিয়ে দিলে ঘটনাটি সেখানেই শেষ হয়ে যায়।

কিন্তু সেদিনের সংঘটিত তুচ্ছ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে সোলতান আহমদ ও তার লোকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিলকে তাল করে ঘটনাটিকে রাজনৈতিকভাবে রূপ দেন। আনছার উল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের ইয়াবা কারবারী ও মানব পাচারকারী ‘তকমা’ দিয়ে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। এ ঘটনায় সোলতান আহমদের কনিষ্ঠ পুত্র শাখাওয়াত হোসেন তুহিন বাদী হয়ে গত ৯ জুলাই রাত ১১’২০ মিনিটে অর্থাৎ ঘটনা ঘটার ৩০ ঘন্টা পর উখিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যা উখিয়া থানার মামলা নম্বর-১৭/২০২০ ইংরেজি। মামলায় ৫ জনকে এজাহারভুক্ত ও আরো ৪/৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়।

জানা গেছে, এজাহারভুক্ত ৫ জন আসামীর ৩ জনই ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেননা। স্থানীয় নিরীহ লোকজন, ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নন, এমন সরকারি কর্মচারীকেও উক্ত মামলায় উদ্দেশ্যেমূলকভাবে আসামী করে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মামলার এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামী ইসহাক আহমদের পুত্র জাহেদুল ইসলাম (৩২) কে গত ১০ জুলাই রাতে সোনাইছড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে শনিবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ওসি মর্জিনা আক্তার মর্জু। অথচ স্থানীয়দের অভিযোগ, ধৃত জাহেদুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই ছিলেন না।

মামলার এজাহারভুক্ত ৪ নম্বর আসামী মৃত বজল আহমদ এর পুত্র ছানা উল্লাহ (৪৫) গণপূর্ত বিভাগ কক্সবাজারস্থ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের হিসাব সহকারী পদে কর্মরত। তিনি জালিয়াপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী সদস্য। তিনি ৮ জুলাই ঘটনার দিন সকাল ৮ টা থেকে ২ টা, আবার মধ্যাহ্ন ভোজ ও জুহুরের নামাজের বিরতির পর বেলা আড়াইটা থেকে রাত ৭ টা পর্যন্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে তার দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ কক্সবাজারস্থ নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন আহমদ গত ৯ জুলাই নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ১৮ নম্বর স্মারকে অফিসে দায়িত্বপালন করার একটা প্রত্যয়ন পত্রও ছানা উল্লাহকে দিয়েছেন। অথচ এই ছানা উল্লাহ’র নির্দেশেই অন্য ৪ জন আসামী সোলতান আহমদকে মারধর করেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

একইভাবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ধৃত জাহেদুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। আবার এজাহারের ৪ নম্বর আসামী সেলিম উদ্দিন প্রকাশ ভেলাইয়্যা ঘটনাস্থলে থাকলেও তিনি মারামরিতে সম্পৃক্ত ছিলেননা বলে ঘটনার আগে থেকেই ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

এদিকে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উখিয়া থানার এসআই ফরহাদ রাহী বলেছেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার পশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করা হবে। তদন্তে যেভাবে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসবে, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে সেভাবেই প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

মামলায় নিরীহ লোকজন, সরকারী কর্মচারীদের অহেতুক জড়ানো হয়েছে বলে যে, অভিযোগ উঠেছে তা সঠিক কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে মামলার আইও সাব ইন্সপেক্টর ফরহাদ রাহী বলেন, এটা আমি শুনেছি। তবে পরিপূর্ণ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিযোগ সঠিক তা বলা যাবেনা। তাছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মামলার সার্বিক কার্যক্রমে একটু বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে বলে আইও ফরহাদ রাহী জানান। আর ঘটনার মাত্র ৯৬ ঘন্টা পার হয়েছে মাত্র।

তিনি বলেন, তদন্ত পর্যায়ে থাকা মামলা সম্পর্কে মন্তব্য করাও বিধিসম্মত নয়। আপাতত সোলতান আহমদকে মারধরের যেসব আঘাত দৃশ্যমান রয়েছে, তার ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে মামলা এগিয়ে নিচ্ছেন বলে আইও ফরহাদ রাহী জানান।

এদিকে, মামলায় নিরীহ ও সরকারী কর্মচারীদের অন্যায়ভাবে জড়ানো হলো কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে মামলার বাদী সোলতান আহমদ এর কনিষ্ঠ সন্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র শাখাওয়াত হোসেন তুহিন বলেন, যে ৫ জনকে এজাহারভুক্ত আসামী করা হয়েছে-তারা সকলেই ঘটনাস্থলে থেকে ঘটনায় অংশ নিয়েছে। এজাহারের বর্ননা অনুযায়ী তার পিতার মুখের বাম পার্শ্বের উপরের সারির ২ টি দাঁত আসামীরা মেরে ফেলে দিয়েছে বলে যে বর্ননা উল্লেখ করা হয়েছে, মেরে ফেলে দেওয়া সে ২ টি দাঁতের চিকিৎসা হচ্ছে কিনা-জানতে চাইলে শাখাওয়াত হোসেন তুহিন দাঁতের চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেননা বলে বলে সিবিএন-কে অবহিত করেন। তবে তার পিতা বয়স্ক হওয়ায় কথিত ফেলে দেওয়া দাঁত ২ টি ঘটনাস্থলেই হেরে গেছে বলে শাখাওয়াত হোসেন তুহিন জানান। অবশ্য সোলতান আহমদ এর ২ টি দাঁত তাকে প্রহার করে ফেলে দেওয়ার বিষয়টি আদৌ সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের ৫ তলায় চিকিৎসাধীন থাকা শাখাওয়াত হোসেন তুহিনের পিতা সোলতান আহমেদকে চোখের ও হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য রোববার ১১ জুলাই রাত্রে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হতে পারে বলে তিনি জানান। শনিবার সন্ধ্যায় তার পিতাকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে কক্সবাজার শহরে এক নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে রাখা হয়েছে বলে শাখাওয়াত হোসেন তুহিন জানিয়েছেন।

এদিকে, ঘটনার বিষয়ে জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত মৃত বজল আহমদ এর পুত্র আনছার উল্লাহ ঘটনা করেছে।

মামলায় আরো যে ৪ জনকে আসামী করা হয়েছে বলে শুনেছি, তাঁরা কেউই ঘটনার সাথে জড়িত নয় বলে স্থানীয় লোকজন থেকে জেনেছি।

ধৃত জাহেদুল ইসলাম অনেক আগে বাদী পক্ষের বিরুদ্ধে একটি মামলা করায় তার প্রতিশোধ হিসাবে তাকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে শুনেছি। আবার ছানা উল্লাহ একজন সরকারি কর্মচারী। সে ঘটনায় থাকার কথা নয়। এছাড়া সেলিম উদ্দিন প্রকাশ ভেলাইয়্যা ঘটনাস্থলে থাকলেও তিনি মারামরিতে সম্পৃক্ত ছিলেননা বলে তিনি জেনেছেন। চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী এ ঘটনায় জড়িত প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় এনে নিরীহ লোকজনকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানী না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।

এভাবে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন স্থানীয় জনসাধারণ। তাঁরা নিরপেক্ষ তদন্ত পূর্বক প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে, নিরীহ ও ঘটনায় জড়িত নয়, এমন লোকজনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

আরও খবর