করোনা মহামারিতে থমকে গেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আলোচনা

অনলাইন ডেস্ক ◑ কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আলোচনা নতুন করে শুরু করতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। মিয়ানমারের অনুরোধে তা দুই মাস পিছিয়ে মে মাসে করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈঠকটি আর হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আলোচনাই কার্যত থেমে গেছে।

ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনে কর্মরত বাংলাদেশের দুজন কূটনীতিক জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে আগামী আগস্ট মাসেও বৈঠকটি হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর আগস্টে না হলে এ বছর বৈঠকটি আর না-ও হতে পারে। কারণ, নভেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দেশটি আলোচনায় বসতে আগ্রহী হবে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি সই করেছিল। এর পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রত্যাবাসন শুরু করতে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (জেডব্লিউজি) গঠন করা হয়। জেডব্লিউজির চতুর্থ ও শেষ বৈঠক হয় গত বছরের মে মাসে মিয়ানমারের নেপিডোতে। বাংলাদেশ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জেডব্লিউজির পঞ্চম বৈঠকটি করতে চেয়েছিল।

সাবেক কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জোট, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ, মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনেকটা আড়ালে রেখেই প্রত্যাবাসনের চেষ্টা হয়েছে। আবার চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশ গত বছরের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম তারিখ ঠিক করেছিল দুই দেশ। দুটি চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য দ্বিপক্ষীয় পন্থা বা চীনের মধ্যস্থতা যে কাজ করছে না, এটি এখন অনেকটাই প্রমাণিত। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত চাপ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে কি না, সে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের পরবর্তী কৌশল কী, সেটিও স্পষ্ট নয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন শুক্রবার বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের লোক। তাদের সেখানেই ফিরে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের জন্য শুধু মানবিক সহায়তা দিয়েই বসে আছে। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা বারবার বলেছি, মিয়ানমারকে চাপ দিন। চাপ না দিলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না। কাজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়া।’

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিধনের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে যে অভিযান শুরু করে, সেটিকে গণহত্যা বলেছে জাতিসংঘ। নৃশংসতার শিকার রোহিঙ্গারা তখন প্রাণ বাঁচাতে রাখাইন থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে। সেখানে এখন ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মিয়ানমারের কাছে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ ধাপে মোট ৫ লাখ ৯৭ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে চলতি বছরের শুরুতে একসঙ্গে ৪ লাখ ৯২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়েছে। এসব তালিকা থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১১ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নিতে তৈরি আছে বলে জানিয়েছে।

চীনের উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক নীরবতা

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ ফিরিয়ে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের কথা বলে আসছে। তবে বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে।

কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, চীন, জাপান, কোরিয়াসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোও মিয়ানমারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টিতে আগ্রহী নয়।

মিয়ানমারের সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে রাখাইনের নৃশংসতার পর থেকে দেশটির মোট রপ্তানি ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। তাদের রপ্তানি পণ্যের বড় গন্তব্য ইউরোপের দেশগুলো। আবার ২০১১-১৫ সালের তুলনায় ২০১৬-১৯ সালে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) পাচ্ছে দেশটি। যদিও রাখাইনে সহিংসতার পর মিয়ানমারের জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে তাঁদের ইউরোপ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ইইউ।

মার্কিন আদালতে মামলা

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো ফেসবুকে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পোস্ট (মন্তব্য ও ছবি) দিত। এসব পোস্টকে গণহত্যার আলামত হিসেবে হাজির করতে চায় গাম্বিয়া। তাই পোস্টের তথ্য প্রকাশের জন্য ফেসবুককে বাধ্য করতে এবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে মামলা করেছে গাম্বিয়া।

গত ৫ জুন আইনি পরামর্শক সংস্থা মিলার অ্যান্ড শেভালিয়ের চার্টার্ডের দুই আইনজীবী পিটার ও টুল এবং আয়েশা হুসেইন গাম্বিয়ার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার আদালতে মামলাটি করেন। দুই আইনজীবী তাঁদের আবেদনে বলেন, মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দেওয়া বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যায়। তাই আদালত যেন ফেসবুককে ওই সব তথ্য দেওয়ার নির্দেশনা দেন।

মামলার পর এনবিসি নিউজ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ওই মামলার বিষয়ে নির্ধারিত আইন মেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

কয়েক মাস আগে মিয়ানমারের ২০টি অ্যাকাউন্ট ফেসবুক বন্ধ করেছে। ওই ২০টি অ্যাকাউন্টের সব তথ্য প্রকাশের জন্য ফেসবুককে নির্দেশ দিতে আদালতে আবেদন জানিয়েছে গাম্বিয়া।

এর আগে গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়া মামলা করে। মামলার প্রাথমিক শুনানির পর আইসিজে ২৩ জানুয়ারি চার দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। এর মধ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ এবং গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সাক্ষ্য-প্রমাণ রক্ষা করতে মিয়ানমারকে নির্দেশের বিষয়টি ছিল। এ ছাড়া চার মাসের মধ্যে আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আদালতকে জানাতে হবে।

আইসিজের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী মিয়ানমার নির্ধারিত চার মাসের মধ্যেই আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে, তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মিয়ানমারের যেহেতু অনেক সম্পদ আছে, তাই অনেকেই তাদের সঙ্গে থেকে সুবিধা আদায় করতে আগ্রহী। এতে এগিয়ে আছে চীন, জাপানও পিছিয়ে নেই। এই সমস্যা সমাধানের কোনো লক্ষণও আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাই বুঝে-শুনে পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

আরও খবর