একাত্তর বছরে কতটা সফল আ.লীগ

বাংলা ট্রিবিউন ◑ ২৩ জুন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দীর্ঘ ৭১ বছরে আওয়ামী লীগের রয়েছে অনেক বড় বড় অর্জন। স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী দলটির রয়েছে নানা সফলতা। রয়েছে টানা ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড। অবশ্য নানা ক্ষেত্রে দলটির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কিছুক্ষেত্রে আপস করতে হয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন এ দলকে। এক সময়কার কর্মীনির্ভর দলটি সাত দশকে এসে নেতানির্ভর হয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া, টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে সরকার ও দল একাকার হওয়ার অভিযোগও আছে।

দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ৭১ বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। আবার কিছুক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আদর্শচ্যুতি ঘটেছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

অবশ্য কিছু দুর্বলতার কথা স্বীকার করলেও সরকার ও দল একাকার হওয়ার বিষয়টি মানতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দাবি, বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশে কম বেশি এ ধরনের চিত্র রয়েছে। নতুন টার্মে ক্ষমতায় এসে সরকার ও দলকে পৃথক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও এসেছে। নেতারা জানান, ভবিষ্যতে এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। সে সময় দলটির নাম আওয়ামী-মুসলিম লীগ রাখা হলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতে ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। দলটির নেতৃত্বে ভাষা অন্দোলন ও স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালিত হয়। দলের সভাপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রাম করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পর প্রায় চার বছরসহ বর্তমান পর্যন্ত ২১ বছর ক্ষমতায় এ দলটি। বর্তমানে টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করছে। অবশ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর টানা ২১ বছর দলটিকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে।

৭১ বছরের ইতিহাসে দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা ৩৯ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। আর বঙ্গবন্ধু সব মিলিয়ে ২৪ বছরের মতো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন।

৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলটির সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

আগের আওয়ামী লীগ আর বর্তমান আওয়ামী লীগের পার্থক্য করতে গিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাকালীন আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ ছিল একটি কর্মীনির্ভর দল। এখন দলটি নেতানির্ভর হয়ে পড়েছে। শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ ছিল তরুণ নেতাদের দল, আর এখন বুড়ো নেতাদের দল। এ দলে তরুণ নেতৃত্ব সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। নেতৃত্বে তরুণ প্রজন্ম আসছে না।’

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনস্বীকার্য বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে টানা ক্ষমতায় থাকায় দলটি ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘সরকার সমর্থিত হওয়ার কারণে এখন দলের মধ্যে কোনও প্রাণ নেই। এখন দল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার আর দল একাকার হয়ে গিয়েছে। সরকার দল চালায়।’

সর্বশেষ সম্মেলনে দল এবং সরকার আলাদা করার প্রচেষ্টার বিষয়ে গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এখানে তরুণ এবং দলে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনকে বাদ দিতে দেখেছি। সিনিয়র কোনও নেতা বাদ যাননি। তারা দলেও আছেন সরকারেও আছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মন্ত্রিসভায় থাকলে সেটাকে বাদ দেওয়া বলে না।’

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের পদধারীরা সরকারের মন্ত্রিসভায় সম্পৃক্ত হবেন না— অতীতে এমন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ অন্যরা কেউ কেউ দলের স্বার্থে মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি। আবার কেউ মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার কারণে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ আর নেই। তখন দল আলাদা ছিল সরকার আলাদা ছিল। যার কারণে দল শক্তিশালী ছিল। এখন আওয়ামী লীগের দলীয় কোনও শক্তি নেই। সরকারের শক্তিতেই দল চলে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত সাত দশকে সমাজ পাল্টেছে, দেশ পাল্টেছে, পৃথিবীও পাল্টেছে। ফলে আওয়ামী লীগ বলে নয়, কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে অপরিবর্তিত থাকা সম্ভব নয়, থাকার কথাও নয়। বস্তুত তা উচিতও নয়। সেই বিবেচনায় বলবো, কিছু পরিবর্তন হয়েছে— যা অনেক বড়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগের অনেক সফলতা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার— এটা তাদের অনেক বড় সাফল্য। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। আবার সীমাবদ্ধতা যে নেই, তাও নয়। একটা বিষয়ে সীমাবদ্ধতার কথা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, তাহলো রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কী হবে। এক্ষেত্রে পূর্বে এ দলের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল, তা এখন ততটা নেই। আর একটা সীমাবদ্ধতার কথা বলবো, তাহলো দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান। দলের মধ্যে যারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযানের সুযোগ ছিল। কিছু লোককে যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে অন্যরা সতর্ক হবে। অবশ্য সেই সুযোগটি এখনও যে নেই, তা বলবো না।’

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘যেকোনও কারণে হোক বাংলাদেশের নির্বাচনি সংস্কৃতিতে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। দেশের নির্বাচনি সংস্কৃতিটা টিকিয়ে রাখা বা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কাঁধে বর্তায়। ক্ষমতাসীন ও দেশের ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে এই জায়গাটায় আওয়ামী লীগ একটা লিডিং রোল প্লে করতে পারে।’

আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতা সম্পর্কে কম সচেতন উল্লেখ করে শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে নেপালকে বাদ দিলে অন্য ছয়টিতে উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো সংকুচিত হচ্ছে। পাকিস্তানের পিপলস পার্টি বলি, ভারতের কংগ্রেসের কথা বলি বা শ্রীলঙ্কার কথা বলি— সবখানেই এটা দেখা যাচ্ছে। এসব দেশে ডানপন্থী- উগ্রপন্থীরা জয় লাভ করছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আওয়ামী লীগই একমাত্র উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, যারা এক্সপান্ড করেছে। এ কারণে উপমহাদেশে উদার গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ইমেজ রি-বিল্ড করার সুযোগ আছে। নির্বাচনি সংস্কৃতিটা ফিরিয়ে এনে তারা এটা করতে পারে। এটা সম্ভব হলে তা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বড় উপকার হতে পারে।’

সরকার থেকে দলকে আলাদা করলেই যে দল শক্তিশালী হবে, বিষয়টি তেমন নয় বলে মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। ভারতের কংগ্রেসের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সোনিয়া গান্ধী নিজে দায়িত্ব না নিয়ে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করার ফলে কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এমন কী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে?’ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপরে বিষয়টি নির্ভর করে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ মনে করেন, বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তার প্রায় সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা ভাষা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় অর্জন করেছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার পথে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’ এত কিছু অর্জনের মধ্যেও আওয়ামী লীগের বেশকিছু দুর্বলতার কথা তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ইতিহাস ও ঐতিহ্য হলো জনগণের ওপর নির্ভরশীলতা। বঙ্গবন্ধু সবসময় নেতাকর্মী ও জনগণের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করতেন। অর্থাৎ, জনগণের দল আওয়ামী লীগ জনগণের ওপর নির্ভর করেই চলেছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, কখনও কখনও আওয়ামী লীগকে অতিমাত্রায় আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য শুভকর নয়। এটি কাম্যও নয়। রাজনীতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে থাকতে হবে।’

একই ব্যক্তির দল ও সরকারের নেতৃত্বে থাকা প্রসঙ্গে ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হয় যে, দল এবং সরকারের নেতৃত্ব ভিন্ন হতে হবে। যার কারণে ওই সময় বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে দলের নেতৃত্ব দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হয়ে দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কাউন্সিলরদের অনুরোধে এক টার্মের জন্য তিনি দলের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে একই দাবি আসলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। দলের পদ ছেড়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে আওয়ামী লীগে আমরা এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় দেখতে পাই। সেই অবস্থান থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগ দল এবং সরকার একই নেতৃত্বের মধ্যে রয়ে গেছে।’

দল ও সরকার পৃথক থাকার মধ্যে অনেক গুরুত্ব রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখানে একটা কথা না বললেই নয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যদি শেখ হাসিনা না থাকেন, অথবা সরকারে যদি না থাকেন, তাহলে যে অর্জন আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটা সম্ভব হতো না। সেই বিবেচনায় দলীয় প্রধান এবং সরকার প্রধানের পদে তার থাকার যথার্থতা রয়েছে। তবে দলের অন্যান্য কর্মকর্তা যারা দলের পোর্টফলিও ধারণ করে আছেন, তাদের সরকারে থাকা উচিত নয় বলে মনে করি। এটা সম্ভব হলে সরকার এবং রাজনীতি উভয়ের জন্য ভালো হবে।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান দলের নানাবিধ সফলতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগ এখন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন এগিয়ে যাচ্ছে।’

দল ও সরকার একাকার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের রীতি বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই কমবেশি রয়েছে। তবে আমরা সরকারের ওপর দলের নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি। সরকারে রয়েছেন এমন অনেকেই সর্বশেষ সম্মেলনে দলীয় পদ থেকে বাদ পড়েছেন। ভবিষ্যতে এ প্রক্রিয়া আরও অব্যাহত থাকবে।’

আওয়ামী লীগের দুর্বলতা প্রসঙ্গে ফারুক খান বলেন, ‘আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে— কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন করতে পারিনি। নিয়ম-কানুনের মধ্যে আনতে পারিনি। যেমন, এখন করোনাভাইরাসকালে মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানানো যাচ্ছে না। মানুষ ট্রাফিক আইন মানে না।’

আরও খবর