ডেস্ক রিপোর্ট ◑
করোনার উপসর্গ নিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছে এনজিও হোপ ফাউন্ডেশন পরিচালিত হোপ ফিল্ড হাসপাতাল। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় অনিচ্ছা সত্বেও উপসর্গ লুকিয়ে রেখেই ফিল্ড হাসপাতালে কর্মরতরা চিকিৎসা দিচ্ছে উখিয়ার কুতুপালং এর ৪নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের। এই হাসপাতালের অপরিপক্কতায় ক্যাম্পে করোনা মহামারী রুপ ধারন করতে পারে। এজন্য ঝুঁকিতে রয়েছে লাখো রোহিঙ্গাসহ হাসপাতালের কর্মরতদের প্রতিবেশিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আয়েশা সিদ্দিকী গত ৩ জুন হোপ ফিল্ড হাসপাতালে মেডিকেল সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। কোনরকম কোয়ারেন্টাইন ছাড়াই জেলার বাইরে থেকে এসে সেদিনই তিনি উখিয়ার কুৃতুপালংয়ের মধুরছড়ার ৪ নং ক্যাম্পের হাসপাতালে কাজ শুরু করেন। কিন্তু গত ৯ জুন কর্মরত অবস্থায় তার বমি, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়া দেখা দেয়। ফলে তাকে সেখানেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপরদিনই তাকে পূণরায় কাজে যোগ দিতে আদেশ করেন হোপ ফিল্ড হাসপাতালের কক্সবাজারের সিনিয়র ম্যানেজার শওকত আলী। করোনার উপসর্গ নিয়ে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেন আয়েশা। একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষের জোরাজুরির কারণে সেদিনই চাকরী থেকে ইস্তফা দেন আয়েশা। একই হাসপাতালের একই পদে কর্মরত মোতালেব। তাঁর শরীরে ৯ জুলাই করোনা পজেটিভ ধরে পরে। আর আগে উপসর্গ থাকায় ২৫ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত হোম কোয়েরান্টোইনে ছিলেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালের ফিল্ড কো অর্ডিনেটর শাহেনাজ বেগমের চাপাচাপিতে কোয়ারেন্টাইন শেষ না করেই কাজে যোগ দেন তিনি। ৯ জুন পর্যন্ত তিনি কাজ করেন। শেষদিনও তিনি ২১ জন রোহিঙ্গার শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করেন। ৯ জুনের পর তাকে আইসোলোশনে রাখা হলেও তার স্ত্রী একই হাসপাতালের অপারেশনের সহকারী নার্স মুক্তাকে কোন ধরনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়নি। ফার্মাস্টিট নাদিম মাহমুদ, ক্লিনার আয়েশা, সেলিনা এক সপ্তাহের অধিক সময় ধরে জ্বর, গলাব্যথা নিয়ে কাজ করেছে একই প্রতিষ্ঠানে। বারবার কোয়ারেন্টাইনে থাকতেও চাইলেও তাদেরকে ছুটি দেয়া হয়নি। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ১০ জুন থেকে তাদের ছুটি মঞ্জুর করা হয়।
এবিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হাসপাতালের কর্মরত এক চিকিৎসক বলেন, এই হোপ হাসপাতালের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের যদি পরীক্ষা করা হয় তবে তাদের অধিকাংশের শরীরের করোনা পজেটিভ পাওয়ার আশংকা রয়েছে। কারণ এই হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স সহ অন্যান্যদের কোন ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই চিকিৎসা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এছাড়া কারো শরীরে করোনা উপসর্গ দেখা দিলেও তাকে কাজে যোগ দিতে ও পরীক্ষা না করাতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং হোপ ফিল্ড হাসপাতাল সূত্র জানায়, এই হাসপাতালের ডা. কাইয়ুম, ডা. আকাশ মজুমদার ও মোতালেব করোনা পজেটিভ। এর মধ্যে ডা. আকাশ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া একই ফাউন্ডেশনে কর্মরত উখিয়ার মালভিটা পাড়ার সালাউদ্দিনের করোনা পজেটিভ। তিনি বর্তমানে তার বসত বাড়িতে রয়েছেন। কিন্তুু ওই কর্মচারীর কোন খবরই নেয়নি সংশ্লিষ্ঠরা।
এছাড়া সহকারী সুপারভাইজার মো. শাহিন, অভ্যর্থনাকারী শিউলি বেগমের শরীরে করোনার সকল উপসর্গ পায় হোপ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। পরে তাদেরকে টেস্ট ও কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দিলেও সেই নির্দেশনা মানার সুযোগ দেয়নি ফিল্ড কর্তৃপক্ষ। ফার্মাসিস্ট নাদিম ও তার স্ত্রী সুমিকে ১০ জুন থেকে বাসায় রাখা হয়েছে কোয়ারেন্টাইনের জন্য। ক্লিনার আয়েশা ও সেলিনার মধ্যে করোনার উপসর্গ থাকায় ৫ দিন বাসার থাকার নির্দেশনা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্মরতদের মতে এই হাসপাতালের এক তৃতীয়াংশ জনবল করোনা উপসর্গ নিয়েই কাজ করছে। যাদের কথা বাইরে জানাজানি হচ্ছে তাদেরকেই বাধ্য হয়ে কোয়ারেন্টাইনে পাঠাচ্ছেন ফিল্ড সুপারভাইজার শাহেনাজ। তবে তার আগে শুনতে হচ্ছে ভর্ৎসনা।
এবিষয়ে মেডিকেল সহকারী মোতালেব বলেন, ঈদের আগে আমার মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। আমি ২৫ জুন থেকে ঈদের ছুটিতে যাই। ২৬ মে পরীক্ষা করি। এর পর কয়েকদিন হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম। এর মধ্যে জরুরী প্রয়োজনে বের হই। একারণে কোয়ারেন্টাইন শেষ হওয়ার আগে অফিসের সিনিয়ররা কল করে আমাকে কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেয়। পরে তাদের নির্দেশমত ৩ দিন কাজ করি। এদিকে ৯ জুন আমার রিপোর্ট আসে পজেটিভ। সেদিন থেকে আমি আইসোলোশনে আছি। তবে আমার স্ত্রী মুক্তার শরীরে উপসর্গ না থাকায় তিনি যথারীতি দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে ফিল্ড কো অর্ডিনেটর শাহেনাজ বেগম বলেন, সবকিছু নিয়ম মেনেই করা হচ্ছে।
আর হোপ ফাউন্ডেশনের কক্সবাজারের সিনিয়র ম্যানেজার শওকত আলী বলেন, আমরা কোভিড হাসপাতাল করার প্রস্তুতি নিয়েছি। অনেককে চিকিৎসা দিয়েছি। সেকারণে আমাদের দুই একজন আক্রান্ত হয়েছে। যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের সকলের চিকিৎসা, কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হচ্ছে। এমনকি উপসর্গ থাকলেও আমরা তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠাচ্ছি। তবে তিনি বলেন মালভিটা পাড়ার সালাউদ্দিনের বিষয়টি তার জানা নেই।
হোপ ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর কে. এম জাহিদুজ্জামান বলেন, উখিয়াতে আমাদের ৪৫০ কর্মকর্তা কর্মচারী কাজ করে। এরা সকলেই রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে কাজ করে। সেই সেবা দিতে গিয়ে কেউ কেউ আক্রান্ত হয়েছেন, কারো কারো উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তাদেরকে আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেছি। অনেকে আবার করোনাকে পূঁজি করে স্বাস্থ্যসেবার কাজে অনীহা দেখানোয় তাদের বিরুদ্ধে আমরা স্বাভাবিকভাবেই কঠোর হচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, অনেকে দাবি করেন তার শরীর গরম লাগছে, কাশি হচ্ছে। তখন আমরা তাকে ছুটি দিয়ে করোনা পরীক্ষা করতে বলি। কিন্তু তারা করে না। এটা হচ্ছে কিছু লোকের কাজে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা।
এবিষয়ে উখিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা (ইউএনও) নিকারুজাম্মান বলেন, এটি কোভিড হাসপাতাল নয়। তারপরও চিকিৎসা দিতে সরকারী নির্দেশনা মানার কথা। এছাড়া করোনা উপসর্গ পেলেই তাকে কোয়ারেন্টাইনে রাখার কথা। এটি আমি প্রতিটি এনজিওকেই বলেছি। তাই বিষয়টি যদি হোপ ফাউন্ডেশন না শুনে থাকে তবে আমি অবশ্যই সংস্থাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করব।
এবিষয়ে অতিরিক্ত শরনার্থী,ত্রান ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা (আরআরআরসি) শামসুদ্দৌজা বলেন, হোপ ফিল্ড হাসপাতালের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা হবে।
তিনি আরো বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসার জন্য তারা একটি সেবা কেন্দ্র খোলার আবেদন করেছেন। তবে যতদূর জানি ওই হাসপাতালে কোভিড রোগিদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, করোনা উপসর্গযুক্ত জনবল দিয়ে চিকিৎসা করানো ও কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থা না করার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে হোপ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত জবাব চাওয়া হবে।/দৈ: কক্সবাজার
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-