অনলাইন ডেস্ক ◑
হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে মৃত্যু হওয়াটাই যেন স্বাভাকি হয়ে ওঠেছে চট্টগ্রামে। বুধবার মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে এমন তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যারা নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে মৃত্যু কোলে ঢলে পড়েন। এরমধ্যে বাদ পড়েনি রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা সাংবাদিকের পিতাও। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে গতকাল বৃহস্পতিবার চমেক হাসপাতালে জরুরি বিভাগেই ১১ জনের মৃত্যু খবর পাওয়া গেছে। যাদের সকলেই শ^াসকষ্ট জনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তথ্য মতে, বুধবার রাত আড়াইটার দিকে মৃত্যু হয় নগর বিএনপির সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিনের (৬০)। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে নগরীর দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকার ৬২ বছর বয়সী প্রীতি বিকাশ দত্ত নামে এক ব্যক্তি। ঠিক এক ঘণ্টা পর ভোর সাড়ে তিনটায় মৃত্যু হয় সাংবাদিকের পিতা জসিম উদ্দিন চৌধুরীর (৬০)। যা নিয়ে ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও প্রতিবাদের ঝড় বইছে রীতিমত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালের দ্বারে ঘুরে ঘুরে মৃত্যু হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে। এ বিষয়ে সরকার গঠিত সার্ভিলেন্স টিমসহ প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকর সংগঠন। তারা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে নজরদারি না বাড়ালে মৃত্যু মিছিল আরও বাড়তে থাকবে এবং কিছুদিন পর রাস্তায়ও মানুষের লাশ পড়ে থাকবে।
এরমধ্যে আলোচনায় এসেছে গত মঙ্গলবার মৃত্যু হওয়া বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম ছগীরের মৃত্যু বিষয়টিও। উপসর্গ না থাকলেও শুধুমাত্র বুকের ব্যথা থাকায় ভর্তি নেয়নি চার বেসরকারি হাসপাতাল। গাড়িতেই মৃত্যু নিশ্চিত হয় ক্ষমতাশীল দলের এ নেতাকে। যা নিয়ে তীব্র ক্ষোভও করেছেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
তারমধ্যেই যোগ হয়েছে ফাতেমা আকতার মুক্তা (৩০) নামে ১০ মাসের এক অন্তঃসত্ত্বা নারী আইসিইউ শয্যা না পেয়ে একই দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে মারা যাওয়ার ঘটনাও। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় বইছে।
১ ঘন্টায় তিনজনের মৃত্যু: এক ঘন্টায় মৃত্যু হওয়া তিনজনের মধ্যে শ^াসকষ্ট নিয়ে তিন হাসপাতাল ঘুরার নগরীর ট্রিটমেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় নগর বিএনপির সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিনের। সেখানে তাকে অক্সিজেন দেয়া গেলেও আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় সেই সুবিধা দেয়া যায়নি। কামাল উদ্দিন নগরীর সরাইপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, বুক ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে কামাল উদ্দিন নগরীর বেসরকারি ম্যাক্স এবং পার্কভিউ হাসপাতালে যোগাযোগ করেও সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। পরে মা ও শিশু হাসপাতালে গেলেও সেখানে অক্সিজেন সুবিধাযুক্ত বেড তাকে দেয়া যায়নি। শুধু অক্সিজেন ও আইসিইউ সুবিধার জন্য তাকে কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরতে হয়েছে। যথাসময়ে চিকিৎসা পেলে হয়তো তিনি মারা যেতেন না।
নগরীর বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতাল সেবা না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু হয় সাংবাদিক পিতার। মৃত জসিম উদ্দিন চৌধুরী (৬০) একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক বণিক বার্তার চবি প্রতিনিধি জোবায়ের চৌধুরীর বাবা।
জোবায়ার চৌধুরী জানায়, নগরীর গরীব উল্লাহ শাহ হাউজিংয়ের নিজ বাসায় মধ্যরাতে অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাতেই জসিম উদ্দিন চৌধুরীকে ন্যাশনাল হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু সপাতালের একজন কর্মচারী অক্সিজেন সেচ্যুরেশন মেপে দেখেন ৮৯। সে মুহুর্তে অক্সিজেন সেবার দরকার থাকলেও তা নিশ্চিত না করে ফ্লু কর্নারে শয্যা খালি নেই উল্লেখ করে ফিরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। পরে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথিমধ্যেই মৃত্যু হয় তার।
রাত আড়াইটার দিকে মৃত্যু হওয়া নগরীর চার হাসপাতাল ঘুরে মৃত্যু হওয়া দক্ষিণ নালাপাড়ার এলাকার বাসিন্দা প্রীতি বিকাশ দত্তের ছেলে অভিজিৎ জানায়, বুধবার রাত সাড়ে আটটায় হঠাৎ তাঁর বাবার বুকে ব্যাথা উঠলে হাসপাতালে ভর্তি উদ্দেশ্যে বের হন। এরমধ্যে নগরীর মা-মনি হাসপাতাল, ম্যাক্স, ন্যাশনাল হাসপাতাল ঘুরেও মিলেনি চিকিৎসা। পরে বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু জরুরি বিভাগে নিয়ে যেতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য :
হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ডেপুটি গভর্নর মো. আমিনুল হক বাবু পূর্বকোণকে বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই চট্টগ্রামে চিকিৎসার জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগী নিয়ে চলতে হচ্ছে। বিপরীতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো তাদের সেবা কার্যক্রমকে লোক দেখানোতে পরিণত করেছে। এরমধ্যে প্রশাসনের কঠোরতায় এসব বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা নিশ্চিত করবেন বললেও, তার কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতেই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষও চুপ। কিন্তু তারা যদি এসব বিষয়ে আরও কঠোর হতো তা হলে এমন চিত্র অনেকটাই কমে আসতো।’
‘সরকারি গঠিত সার্ভিলেন্স টিমের দৃশ্যমান কার্যক্রম না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, দেরিতে হলেও বৃহস্পতিবার থেকে টিমটি অভিযান শুরু করেছে। তবে এটি যদি নিয়মিত হয়, তাহলে কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সেবা পাবে। একই সাথে প্রতিটি হাসপাতালে একটি করে হটলাইন নম্বর ঝুলিয়ে দেয়া হোক, তাহলে রোগীরা তাদের অবস্থার কথা জানাতে পারবে। অভিযোগ পাওয়ার পর যদি দু’একটিতে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়া হয়, এমনিতেই সবগুলো ঠিক হয়ে যাবে বলেও যোগ করেন তিনি।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-