সুজাউদ্দিন রুবেল :
নানা কারণে দেশে ও বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে পরিচিত পর্যটন নগরী কক্সবাজার। কিন্তু এই কক্সবাজার এখন করোনার নতুন হট স্পটে পরিণত হচ্ছে। দিন দিন বেড়েই চলেছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। সাথে বাড়ছে মৃত্যুও।
তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে কক্সবাজারকে রেড জোন ঘোষণা করে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল ও বিশেষজ্ঞরা। তবে পুরো কক্সবাজারকে জেলাকে রেড জোন ঘোষণা নয়; সংক্রমণের হার দেখে উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড ভিত্তিক রেড, গ্রীন ও ইয়েলো জোনে ভাগ করে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজার মেডিকেল ল্যাবের দেয়া তথ্য মতে, গত ৬১ দিনে মোট ৭০৪৮ জন সন্দেহভাজন রোগীর করোনা ভাইরাস টেষ্ট করা হয় কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ল্যাবে। তারমধ্যে ৮৭৩ জনের রিপোর্ট করোনা পজেটিভ পাওয়া গেল। এতে কক্সবাজার জেলার রয়েছে ৭৮৯ জন।
এর মধ্যে মহেশখালীতে ৩২ জন, টেকনাফে ৩৬ জন, উখিয়ায় ১০৫ জন, রামু ৪৯ জন, চকরিয়ায় ১৭৩ জন, কক্সবাজার সদরে ৩২১ জন, কুতুবদিয়ায় ২ জন এবং পেকুয়ায় ৪১ জন রয়েছে। এর সাথে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২৯ জন রোহিঙ্গা। অন্যান্যরা কক্সবাজার জেলার নিকটবর্তী বান্দরবান জেলার বাসিন্দা এবং চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও, সীতাকুঞ্জ, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার বাসিন্দা।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, ইতিমধ্যে করোনায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন কক্সবাজার জেলায় মোট ১৪২ জন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় সুস্থ হয়েছেন ২২ জন, রামু উপজেলায় সুস্থ ২ জন, চকরিয়ায় সুস্থ ৭০ জন, পেকুয়ায় সুস্থ ২১ জন, মহেশখালীতে ২জন, উখিয়া ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুস্থ ৭ জন ও টেকনাফে সুস্থ ৮ জন।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক
মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. শাহীন আব্দুর রহমান বলেন, ‘কক্সবাজারে শুরু থেকে লকডাউন থাকলেও সেভাবে মানা হয়নি। যার কারনে এই পর্যায়ে এসে কক্সবাজার করোনার নতুন হট স্পটে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, কক্সবাজার সদর উপজেলার পৌরসভায় এর সংক্রমণের হারটা বেশি। এখন যেহেতু সীমিত আকারে সব খুলছে তাই সবাইকে কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত।
যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পড়া যদি নিজের সন্দেহ লাগে তাহলে বাসায়ও মাস্ক পড়া, হ্যান্ড গ্লাভস বেশি ব্যবহার না করা। কারণ হ্যান্ড গ্লাভস বেশি ব্যবহার করলে তার জীবাণু নাকে ও চোখে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এই বিষয়গুলো মেনে চলা খুবই জরুরী।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারে সংক্রমণ যেহেতু বাড়ছে; তাই এই মুহুর্তে যদি জেলাকে রেড জোন বিবেচনা করে প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেই তাহলে এটা কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও বা রেড জোন ঘোষণাটা সম্পূর্ণ প্রশাসনের উপর নির্ভর করে।
রামু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোবেল বড়ুয়া বলেন, এই মুহুর্তে কক্সবাজার জেলাকে রোড জোন ঘোষণা করা প্রয়োজন। কারণ দিন দিন কক্সবাজারে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। কেউ কেউ সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মানলেও অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। তাই প্রশাসনের কাছে দাবি থাকবে; কক্সবাজারে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে রেড জোন ঘোষণা করে অন্তত দুই সপ্তাহ কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেয়ার। তাহলেই কিন্তু সংক্রমণ কমে আশার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজার জেলাকে দ্রুত রেড জোন ঘোষণা করে কারফিউ জারী না করলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
এব্যাপারে কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম বলেন, যেহেতু রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার প্রস্তুতি এই মুহুর্তে কক্সবাজারে নাই।
তাই অন্তত আগামী ১৫ দিন কক্সবাজারে গণ-কারফিউ দিয়ে চলমান টেষ্ট রিপোর্টের উপর রোগীদের প্রাতিষ্টানিক কোয়ান্টানে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আর তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের টেষ্ট রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত হোম কোয়ারান্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই কক্সবাজারে করোনার সংক্রমণ কমানো সম্ভব।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই প্রশাসন নিরসলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে কোন ধরণের সচেতনতা নেই। কেউ সামাজিক দূরত্ব, হাত ধোঁয়া কিংবা মাস্ক পড়ার নিয়ম মানছেন না। আবার দেখছি, করোনা আক্রান্ত হবার পরও কক্সবাজার থেকে মহেশখালী ঘুরতে যাচ্ছে। তাহলে কক্সবাজারে কিভাবে করোনা সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে? মানুষ যদি সচেতন না হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তো সহযোগিতাও অব্যাহত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার যেহেতু দেশকে ৩ জোনে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; এই সিদ্ধান্তের আওতায় কক্সবাজারকে রেড জোনে ভাগ করে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে হবে। তার জন্য প্রশাসনকে সর্বাধিক কঠোর হতে হবে।
আরেকটি বিষয় প্রশাসনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, সেটি হল কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প যেন খুলে দেয়া না হয়। এব্যাপারে আমরাও প্রশাসনকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাব।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহাবুবর রহমান জানান, করোনায় এ পর্যন্ত কক্সবাজারে মৃত্যু বরণ করেছেন ১৬ জন। তারমধ্যে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের একজন রোহিঙ্গা রয়েছে।
কক্সবাজারে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে এটা সত্য। কক্সবাজার জেলা সব তথ্য কিন্তু জাতীয় কমিটির কাছে রয়েছে। সুতরাং, কক্সবাজারকে কিভাবে করোনার সংক্রমণ ঠেকাবে তার সিদ্ধান্ত জাতীয় কমিটি নিবে।
আর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে প্রশাসন সব ধরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ল্যাবের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।
এছাড়াও নতুন করে চকরিয়ার ডুলহাজারায় একটি নতুন ল্যাব করার চেষ্টা চলছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ও ১০ শয্যার এইচডিইউ সেবা চালু হবে। যেখানে বসানো হবে আধুনিক মেডিকেল ভেন্টিলেটর।
এছাড়াও সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে অবস্থিত হোটেল সী-প্রীন্সেসকে দু’শো শয্যার আইসোলেশন ইউনিট করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরপর একটি ফিল্ড হসপিটাল করার পরিকল্পনা চলছে।
মো. কামাল হোসেন আরও জানান, কক্সবাজার পুরো জেলা কে রেড জোন ঘোষণা করা হবে না। তবে এলাকা ভিত্তিক জোনে ভাগ করা হবে।
যেমন উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড। যে এলাকায় করোনা সংক্রমণের হার যেমন হবে ঠিক সেভাবে ওই এলাকাকে রেড, গ্রীন ও ইয়েলো জোনে ভাগ। সংক্রমণের হার যদি বেশি হয়, তাহলে ওই এলাকা লকডাউন করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-