কক্সবাজার সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপর দিকে: নজিরবিহীন ঘটনা

আহমদ গিয়াস ◑

কক্সবাজার শহর ও শহরতলীর সমুদ্র তীরবর্তী পর্যটন এলাকায় ভ‚-গর্ভস্থ পানির স্তর উপর দিকে ওঠে আসছে। বৃষ্টিহীন চরম শুষ্ক মৌসুম হলেও চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে অভাবনীয়ভাবে শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে না নেমে উপর দিকে ওঠে আসতে শুরু করে। এ নজিরবিহীন ঘটনায় বিস্মিত স্থানীয় বাসিন্দারা। লকডাউনের কারণে পর্যটন শিল্প বন্ধ থাকায় ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির জলাধার প্রাকৃতিকভাবে রিফিল বা রিচার্জ হয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপর দিকে আসতে পারে বলে মনে করেন ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।

গত দুই দশকে কক্সবাজার শহরের কলাতলী পর্যটন জোনের মাত্র ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় গড়ে ওঠেছে লক্ষাধিক মানুষের থাকার সুবিধা সম্বলিত চার শতাধিক আবাসিক হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস ও বহুতল ফ্ল্যাট ভবন। ফলে অতি ঘনত্বের কারণে ডিসেম্বরের শেষদিক থেকে এসব অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নামতে থাকে। হাজার হাজার অগভীর নলকূপ বিকল হতে শুরু করে। এ বছরও যথারীতি বিকল হয়েছে। কিন্তু চলতি এপ্রিল মাসের ৬-৭ তারিখ থেকে অভাবনীয়ভাবে শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে না নেমে উপর দিকে ওঠে আসতে শুরু করে এবং বিকল অগভীর নলকূপগুলো আকস্মিকভাবে সচল হতে শুরু করে বলে জানান কলাতলীর কৃষক আসমত আলী।

তিনি জানান, এখন মাত্র ১০ ফুট নীচেও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আগে মে মাসের শেষদিকে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার পরই ভূগর্ভের এই অবস্থানে পানি মিলত। অথচ এখন শুষ্ক মৌসুমের এই সময়ে পানির স্তর উপরে ওঠে আসতে শুরু করেছে, যে ঘটনা নজিরবিহীন বলেও মনে করেন তিনি।

লকডাউনের কারণে পর্যটন শিল্প বন্ধ থাকায় ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির জলাধার প্রাকৃতিকভাবে রিফিল বা রিচার্জ হয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপর দিকে আসতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে কলাতলীর হোটেল মোটেল জোনে দৈনিক এক কোটি লিটারের বেশি ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হয়। যা প্রাকৃতিকভাবে রিফিল হতে না পারায় শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামতে থাকে।

৫ কিলোমিটার সৈকতজুড়ে অবস্থিত কলাতলী পর্যটন এলাকায় প্রতি বছর মে মাসের শেষদিক থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সময়ে ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পর্যটক বাড়ার সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ: নিচে নামতে থাকে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

শহরের সত্তরোর্ধ টিউবওয়েল মিস্ত্রি আবু জানান, ২ দশক আগেও শহরের বাহারছড়া থেকে কলাতলী পর্যন্ত এলাকায় মাত্র ১০ থেকে ২০ ফুটের মধ্যে অগভীর নলকূপ আর ৩৫ থেকে ৪০ ফুটের মধ্যে গভীর নলকূপ বসানো হত। আর ৩৫-৪০ ফুটের গভীরতার নলকূপ থেকেই বছরের পর বছর ধরে ঝর্ণার মতই বেরিয়ে আসত সুস্বাদু সুপেয় জল। আর সেটা স্বাধীনতার পরও ছিল মাত্র ২০-২৫ ফুটের মধ্যে। সেসময় বরাক বাঁশকে পাইপ বানিয়ে ঝর্ণার মত করে পানি তোলা হত।

পর্যটন শিল্পের বিকাশের কারণে গত দুই দশকে কক্সবাজারের ভূমির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিবর্তন আসায় ভূগর্ভস্থ পানির মজুদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে এবং যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানিতে ইউরেনিয়াম থোরিয়ামের মত ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থ ও লবণাক্ত পানি মিশে যাচ্ছে।

তিনি জানান, সাম্প্রতিক কিছু জরীপে শহরের কিছু অংশে সহনীয় মাত্রার ৫-৬ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয় পদার্থ ও লবণাক্ততার উপস্থিতি ধরা পড়ে। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকির।
কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ইউনুছ জানান, পানীয় জলের সাথে শরীরে সহনীয় মাত্রার বেশি ইউরেনিয়াম থোরিয়ামের মত ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থ গ্রহণ করা হলে শরীরে ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে, শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা দূর্বল করে দিতে পারে। আবার অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কারণে উচ্চ রক্তচাপজনিত নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

তবে কক্সবাজারের ভূগর্ভস্থ পানিতে শুষ্ক মৌসুমে ক্ষতিকর পদার্থের কোন উপস্থিতি আছে কিনা তা নিয়ে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের কক্সবাজারস্থ খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্র এখনও জরীপ করেনি বলে জানান এই কেন্দ্রের পরিচালক ড. মোহাম্মদ রাজিব।

তিনি বলেন, সৈকত খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে এ কেন্দ্রের কার্যক্রমের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির জরীপ অন্যতম হলেও এ বিষয়ে এখনও কাজ শুরু করা যায়নি।

তবে এই শুষ্ক সময়ে ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ রিফিল হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় পানির স্তর উপরে ওঠে এসেছে বলে মনে করেন তিনি।

আরও খবর