সুজাউদ্দিন রুবেল ◑
সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় যেতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশে ফিরেছেন চার শতাধিক রোহিঙ্গা। দুই মাস ট্রলারে করে সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় তাদের সঙ্গে থাকা ৬০ রোহিঙ্গা মারা গেছেন। ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কয়েকজন এ তথ্য জানিয়েছেন।
কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্প ৫ এর রোহিঙ্গা আনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দুই মাস আগে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপের ঝাউবাগান থেকে রওনা হই। প্রথমে ছোট নৌকা, তারপর বড় ট্রলার। এরপর মগদের বড় একটি গাছের ট্রলারে উঠি। প্রথমে নৌকায় ছিল ৩৫ জন, তারপর ট্রলারে উঠে দেখি ৮১ জন। এরপর বড় ট্রলারে ওঠার পর তিন দিন ধরে মানুষ তুলতে থাকে দালালরা। তিন দিনে ৫০২ জন মানুষকে ট্রলারে ওঠানো হয়। এরপর আরো দুই দিন ট্রলারটি বঙ্গোপসাগরে ছিল। সাত দিন পর মালয়েশিয়ার সাগরে পৌঁছার পর পাঁচ-ছয় দিন ওইখানে থাকি। দালালরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার পর ট্রলারটি মালয়েশিয়া থেকে থাইল্যান্ডে নিয়ে যায়। খাবার সংগ্রহ করার পর আরো তিন দিন থাইল্যান্ডে অবস্থান করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘দেড় মাসে তিন বার মালয়েশিয়ার কাছে যাই। কিন্তু সে দেশে ঢুকতে না পেরে আবার থাইল্যান্ডে চলে আসি। শেষ পর্যন্ত দালালরা আবার ট্রলারটি সেন্টমার্টিনে এনে ১০দিন রাখে। ১০ দিন পর খাবার শেষ হয়ে যায়। এরপর দালালরা ট্রলারে থাকা নারীদের ধর্ষণ করার চেষ্টা করলে মারামারি লেগে যায়। তখন একজন দালালকে মেরে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। তখন দালালরা ভয় পায়। এরপর নতুন একটি ট্রলার এনে মগ দালালদের আটজন ওই ট্রলারে উঠে চলে যায়। বাকি দুই দালাল ট্রলারটি চালিয়ে পাঁচ দিন পর টেকনাফে নিয়ে আসে। ট্রলারে করে দুই মাস সাগরে থাকার সময় ৬০ জন মারা যায়। তাদের মধ্যে কেউ খাবার না পেয়ে, আবার কেউ অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ট্রলারে জানাজা পড়ে তাদেরকে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।’
বৃহস্পতিবার টেকনাফের শীলবুনিয়া সমুদ্র পয়েন্টে থেকে চার শতাধিক রোহিঙ্গাকে কোস্ট গার্ড উদ্ধার করলেও আনোয়ার ইসলাম কৌশলে পালিয়ে ঢুকে পড়েন লোকালয়ে। একইভাবে পালিয়ে আসেন উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প-২, জি-১ ব্লকের রোহিঙ্গা আনোয়ার আলম।
আনোয়ার আলম বলেন, ‘মালয়েশিয়ার যাওয়ার জন্য মহেশখালী সমুদ্র উপকূল থেকে ট্রলারে করে যাত্রা করি। ট্রলারে খেতে পারেনি। অসুস্থ ছিলাম। আমাদের খেতে দিতো না। পানি নিয়ে কষ্ট দিত দালালরা। এভাবে দুই মাস সাগরে ভেসে ছিলাম। ৬০ জন মারা গেছে।’
এদিকে, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল থেকে উদ্ধারের আগেই ৬০ থেকে ৭০ জন রোহিঙ্গা পালিয়ে লোকালয়ে চলে গেছেন। এসব রোহিঙ্গা কোয়ারেন্টাইনে না থেকে পালিয়ে যাওয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় আছেন স্থানীয়রা।
টেকনাফের বাহারছড়ার বাসিন্দা মৌলানা রশিদ আহমদ বলেন, ‘দুজনকে দেখে আমি জিজ্ঞাসা করি, কোথা থেকে এসেছেন? তারা বলেন, মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে ছিলাম, ট্রলারটি সাগরের পাড়ে পৌঁছালে এখানে চলে আসি।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কাশেম বলেন, ‘প্রশাসনের নির্দেশে ট্রলার থেকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে বালিয়াড়িতে রাখে রোহিঙ্গাদের। এসময় পুলিশ, বিজিবি ও কোস্ট গার্ড ছিল। কিন্তু এরা আসার আগে কিছু রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছে। যেটা স্থানীয়দের জন্য আতঙ্কের বিষয়।’
এদিকে, উদ্ধারকৃত ৩৯৬ রোহিঙ্গাকে ইতোমধ্যে ইউএনএইচসিআররের মাধ্যমে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। তাদেরকে শুক্রবার টেকনাফের কেরুনতলী ও নয়াপাডা ট্রানজিট ক্যাম্পে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে কোয়ারেন্টানে রাখা হয়েছে। তাদেরকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। কোয়ারেন্টাইন শেষে তাদেরকে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে ফিরলেই কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে ক্যাম্পে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি বলেন, ‘এখানে ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। যদি কোস্ট গার্ড থেকে মানবপাচারের অভিযোগ পাই, তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বৃহস্পতিবার কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা থেকে ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড। উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। এরা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-