কক্সবাজারে ‘বরোনা’ দিয়ে করোনা প্রতিরোধের চেষ্টা!

ডেস্ক রিপোর্ট ◑ আগের যুগে দেশে মহামারি দেখা দিলে এলাকার মানুষ পাড়া-মহল্লা ও বসতঘরে মহামারি প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসাবে তাবিজ-দোয়া ও ঝাঁড়ফুঁক দিত। সেই আদি ব্যবস্থা যেমনি প্ল্যাগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং বসন্ত-কলেরা মহামারির সময় চালু ছিল তেমনি চলমান করোনা মহামারিতেও অব্যাহত রয়েছে। এমনকি ব্যবস্থা করা হয়েছে ‘করোনা’কে ‘বরোনা’ (মাটির তৈরি ডেকচির ঢাকনার স্থানীয় নাম বরোনা) দিয়ে ঢেকে দেওয়ারও।

দেশের সীমান্তবর্তী কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে এখনো পর্যন্ত এমন আদিকালের সংষ্কৃতি এবং বিশ্বাস চালু রয়েছে। এলাকার কিছু মানুষ এখনো বিশ্বাস করে কোন দৈত্য এসব মহামারি বহন করে নিয়ে এসে এলাকায় দিয়ে যায়। সেখান থেকেই পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে। এসব মানুষের বিশ্বাস-মহল্লা, পাড়া এবং নিজ নিজ ঘর-দুয়ার যদি তাবিজ-দোয়া, পানি পড়া দিয়ে বন্ধ (এক প্রকারের লকডাউন) করে দেওয়া যায় তাহলে নিজেরা রক্ষা পেল।

তাবিজ-দোয়া, পানি পড়া দিয়ে পাড়া এবং ঘরের চারিদিকে ঘুরে অনেকেই মাটির তৈরি বরোনা (ডেকচির ঢাকনা হিসাবে গ্রামে ব্যবহৃত হয়) টাঙিয়ে দেয়। আবার কেউবা টাঙিয়ে দেয় কাপড় দিয়ে কিছুদূর অন্তর পতাকার মতো করে। গ্রামের প্রবীণরা জানান, এখন লকডাউন করা হয় মানুষের চলাচলের ওপর। আর তাবিজ-দোয়া লিখে বরোনা এবং কাপড় টাঙিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয় মহামারিবাহী দৈত্যকে। সেটাও এক প্রকারের লকডাউন।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী এসব বিষয়ে জানান- ‘আগের জমানায় এরকম করার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এখন মানুষ অনেক সচেতন। আগের কুসংস্কার থেকে অনেকেই বেরিয়ে এসেছে। তবে অনেক পাড়া-মহল্লায় কিছু লোক এখনো তাবিজ-দোয়া দিয়ে মাটির তৈরি বরোনা ঢাকনা টাঙিয়ে থাকেন বলে খবর পেয়েছি।’ তিনি বলেন, লোকজনকে আরো সচেতন করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, যাতে কুসংস্কারে কেউ বিশ্বাস না করে।

বিজ্ঞানের এমন যুগেও এরকম অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া, রামু, টেকনাফ এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মহামারি করোনাকে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে বরোনা দিয়ে। উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সভাপতি আজিজুর রহমান জানিয়েছেন, তার নিজগ্রাম পাতাবাড়ী এলাকার মহল্লায় এরকম মহামারি প্রতিরোধক বরোনা টাঙানো হয়েছে। স্থানীয় মৌলভী ডেকে মাটির তৈরি এসব বরোনায় দোয়া-দরুদ লিখে টাঙ্গানো হয় বরোনাগুলো। পুর্বপাতাবাড়ী বালুছড়া এলাকার নুরুল আলমের ঘরেও এরকম বরোনা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে জানান তিনি।

হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সিকদার জানান-‘এলাকায় কোন সময় মহামারি দেখা দিলে এরকম পদ্ধতি যুগ যুগ ধরেই চালু রয়েছে। আমাদের এলাকার মানুষ এটাকে বিশ্বাস করে। আমার মহল্লায়ও দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন লোকসমাগম নিষিদ্ধ করায় তা করা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, বেশ কয়েকজন আলেম মিলে ফাতেহা পড়ে এসব করতে হয়।

উখিয়া উপজেলার জালিয়া পালং ইউনিয়নের চেপটখালী গ্রামের বাসিন্দা মৌলভী আবুল বাশার জানান-‘গত রবিবার সোনার পাড়া ও চেপটখালী ২ টি গ্রামেই আলেমদের দিয়ে দোয়া-দরুদের মাধ্যমে কাপড়ের পতাকা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহামারি যাতে গ্রামে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্যই এসব দেয়া হয়েছে।’

টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিং সভাপতি আজিজ উল্লাহ জানিয়েছেন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর শীলখালী গ্রামের পাড়াটি তাবিজ-দোয়ার মাধ্যমে কাপড় দিয়ে ‘বন্ধ’ (এক প্রকার লকডাউন) করা হয়েছে। এলাকার রোহিঙ্গা মৌলভী শফি হুজুর পাড়া ‘বন্ধের’ কাজটি করে দিয়েছেন।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তসলিম উদ্দিন চৌধুরী জানান, সেখানকার অনেক পাড়া-মহল্লায়ও বরোনা এবং কাপড় টাঙ্গিয়ে মহামারি প্রতিরোধের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। একই উপজেলার ঘুংধুম ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য  (মেম্বার) খালেদা বেগম জানিয়েছেন, ঘুংধুম ইউনিয়নের অনেক পাড়া-মহল্লায় বরোনা টাঙ্গিয়ে মহামারি প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে।

আরও খবর