আরফাতুল মজিদ, কক্সবাজার ◑
২০১৭ সালের ২ ডিসেম্বর ছুরিকাঘাতের পর পুড়িয়ে হত্যা করা রমজান (১৪) নামের এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করেছিল কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ।
কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের তোতকখালী এলাকার একটি জমি থেকে জ্বালিয়ে দেয়া লাশটি উদ্ধার করা হয়েছিল। এই ঘটনায় নিহত কিশোরের মা ফাতেমা বেগম বাদি হয়ে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছিল। কিন্তু হত্যার ঘটনায় জড়িত আসামি ছিল সন্দেহের বাইরে। এজাহারেও আসামির নাম উল্লেখ ছিল না।
দীর্ঘ ৩ বছর পর অবশেষে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারকৃত আসামি হলেন- আব্দুর রশিদ (৩৬)। গ্রেপ্তারকৃত রশিদ একজন রোহিঙ্গা নাগরিক।
গতকাল রবিবার (১৫ মার্চ) রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালী থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিহত রমজান ছিল হত্যাকারী আব্দুর রশিদের শালা। রোহিঙ্গা রশিদ গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
কক্সবাজার জেলা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মানুস বড়ুয়া সোমবার (১৬ মার্চ) সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আসামির দেয়া জবানবন্দি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আব্দুর রশিদ প্রায় ১৫ বছর পূর্বে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে খুরুশকুল ঘোনার পাড়ার তার এক ভাই আব্বাসের বাড়িতে অবস্থান নেন। এরপর খুরুশকুল মামুন পাড়ার মরহুম আব্দুর রহমানের মেয়েকে বিয়ে করে তার বাড়িতে বসবাস শুরু করে। এর আগে ২০১৫ সালের দিকে হামজার ডেইল এলাকায় একটি জায়গাও ক্রয় করে রোহিঙ্গা রশিদ। জায়গা নেয়ার পর আব্দুর রহমানের মেয়ে শফিকা আক্তারকে বিয়ে করে। পরে শাশুড়ির শর্তমতে শাশুড়ি ও নিজের নামে জায়গাটির নামকরণ করে নেন রশিদ।
ওই সময় শফিকা আক্তারের বিয়ে ১১ মাস পূর্ণ হয় ও সে চার মাসের গর্ভবতীও ছিল। একপর্যায়ে মায়ের কথামতে শফিকা গর্ভের সন্তান নষ্ট করে ফেলে। এ নিয়ে রশিদ ও শফিকার মধ্যে ঝগড়া হয় বহুবার। নিয়মিত ঝগড়ার একপর্যায়ে রশিদকে মারধর করে শশুড় বাড়ির লোকজন। এই নিয়ে স্থানীয় বিচার শালিসও হয়। বিচারে রশিদকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর শফিকার সাথে রশিদের বিয়ে ভেঙে যায়।
বিচারের ধার্য্য বাবদ শাশুড়িকে ১৩ হাজার টাকা প্রদান করে এবং বিভিন্ন সময় মাছ প্রদান করে থাকে রশিদ। বিভিন্ন সময় শাশুড়ির কাছ থেকে জমির কাগজ ফেরত চাইলেও রশিদকে কাগজ ফেরত দেন না শাশুড়ি। কাগজ ফেরত চাইলে বিচারক জমির উদ্দিনও বলে “তোমার জায়গার কাগজও দিব না, তোরে মারধরও করব। জরিমানার টাকা আমাকে না দিয়ে তোর শাশুড়িকে কেন দিলি।” পরে জমির উদ্দিন রশিদকে ধরে নিয়ে মারধর করে তিনি।
বারবার মারধরের শিকার হয়ে মনে মনে প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নেন রশিদ। ঘটনার মাসখানেক পর (২০১৭ সালের ২ ডিসেম্বর) বিকালে টমটম চালক রমজান (রশিদের শালা) এর সাথে দেখা হয় রশিদের। রশিদ তখন শালাকে টমটম নিয়ে খুরুশকুল তোতকখালী পৌঁছে দিতে বলেন।
জবানবন্দিতে রশিদ আরো উল্লেখ করেন, তোতকখালী যাওয়ার আগেই শহরের টেকপাড়া থেকে মদ পান করে রশিদ। এরপর তোতকখালীর একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে টমটমের ভিতরে শালা রমজানকে মারধর করে রশিদ। এ সময় রমজানও পাল্টা আক্রমণ করে রশিদকে। একপর্যায়ে ধারালো ছুরি দিয়ে রমজানের হাতে ও বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করে জমিতে ফেলে দেয়। জমিতে ফেলার পর টমটমের ব্যাটারির (এসিড) পানি রমজানের সারা শরীর ঢেলে দেয়। এতে তার মুখ জ্বলে যায়। শালার মৃত্যু নিশ্চিত করে টমটম নিয়ে পালিয়ে যায় রশিদ। এরপর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে চলে যান রোহিঙ্গা আব্দুর রশিদ।
কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশের পুলিশ পরিদর্শক মানস বড়ুয়া বলেন, ঘটনার পরের দিন সদর থানা পুলিশ খবর পেয়ে পুঁড়ানো অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে। এতে তার চেহারাও পাল্টে যায়। ব্যাটারির পানিতে তার মুখমণ্ডল জ্বলে নষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনায় রমজানে মা বাদি হয়ে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় আব্দুর রশিদ আসামি ছিলেন না। পরে দীর্ঘদিন মামলাটি তদন্ত করেও কোনো ক্লু বের করতে পারেনি থানা পুলিশ। পরে মামলাটি হস্তান্তর হয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশে।
মানস বড়ুয়া আরো বলেন, থানা থেকে হস্তান্তরের পর মামলাটি নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে উঠে আসে রমজানের দুলাভাই আব্দুর রশিদের নাম। পরে প্রযুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানা এলাকা থেকে রোহিঙ্গা আব্দুর রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন রশিদ।
আগামীকাল মঙ্গলবার (১৭ মার্চ) আসামি রশিদকে কক্সবাজার আদালতে প্রেরণ করা হবে বলেও জানান জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-