বাংলা ট্রিবিউন ◑
নারী পুরুষের সমান অধিকার চায়, কিন্তু আলাদা দিবসও পালন করে’, ‘নারী নির্যাতনের জরিপ হলে পুরুষ নির্যাতনের হবে না কেন’, ‘পুরুষের জন্য কি বাকি ৩৬৪ দিন’ নারী দিবস এলেই এ ধরনের নানা প্রশ্ন শোনা যায়। তবে নারীর জন্য বাসযোগ্য একটি পৃথিবী গড়ার আন্দোলনে যারা শরিক হয়েছেন তাদের মতে, নারীর প্রতি ঘটে চলা অন্যায্যতা ও অসাম্যকে প্রশ্রয় দিতে চান যারা, তারাই এমন প্রশ্ন উত্থাপন করেন। এখনও এ বিশ্ব নারীর স্বর শুনতে প্রস্তুত নয় বলেই ধারণা তাদের।
৮ মার্চ, আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এ বছর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবসের শুরু ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুচ কারখানার নারী শ্রমিকেরা দৈনিক শ্রম ঘণ্টা ১২ থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিতের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। সেদিন আন্দোলনের অপরাধে গ্রেফতার হন অসংখ্য নারী। কারাগারে নির্যাতিতও হন অনেকে। তিন বছর পর ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় নারী শ্রমিক ইউনিয়ন।
১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে তারা আদায় করে নেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালের এই দিনে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
এর পর থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
নারী নেত্রীরা বলছেন, সেই একশ’ বছর আগের আান্দোলনের মধ্য দিয়ে পাওয়া অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি বলেই নারীর জন্য এই দিবস জরুরি। আমরা এইদিনে নিজেদের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে একত্রিত হতে পারি।
দেশের নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে ব্র্যাকের প্রিভেন্টিং ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এদের অনেকের অঙ্গহানি ঘটে, প্রাণও যায়। এমন পরিসংখ্যান শুনলে অনেককেই প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়, কেন পুরুষ নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেখা হয় না। কিন্তু, শুধু নারী বলেই তিন মাসের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ নারীর যে বাস্তবতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং ঝুঁকি তা তখন মাথায় রাখা হয় না। একে পারিবারিক কলহের জেরে পুরুষের মানসিক অশান্তির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন অনেকে।’
তিনি আরও বলেন, আমরা অনেকেই ভাবছি সমতা অর্জিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ৫০ বছরে দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশের কাছাকাছিতে গিয়ে ঠেকেছে। তার মধ্যে পুলিশ, সেনাবাহিনীর বড় কর্তা, ফাইটার জেট পাইলট, জেলা প্রশাসক, সাংবাদিকসহ নানা শক্তিশালী পদে নারীর দাপুটে ভূমিকা দেখে অনেকের ভ্রম হচ্ছে সমতা এসে গেছে। তবে, এখনও ৪০ শতাংশ কর্মজীবী নারীর ৯০ শতাংশের বেশি কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে, অর্থাৎ তাদের কাজের কোনও হিসাব নেই। নারীর জমি নেই, তাই কৃষক কার্ড নেই, জমি বন্ধক রেখে ব্যবসার ঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই, বাবার আসনে নির্বাচিত এমপি হওয়ার সুযোগ নেই- এগুলোকে অন্যায্য এবং অসাম্য বলে যে মানবে সে কখনো প্রশ্ন তুলবে না নারীর দিবস কেন লাগে। আর যার কাছে এসব অসমতাকেই ন্যায্য বলে মনে হবে, তিনি প্রশ্ন করবেন কেন আবার দিবস?
নারীর জন্য দিবস কেন, প্রশ্নের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে ‘উই ক্যান’ এর নির্বাহী সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও নারীকে মানুষ মনে করা হয় না বলেই এটি ঘটে। নারীকে ভোগ্য বস্তু মনে করা হয়, ধর্ম দিয়ে, আইন দিয়ে, প্রথা দিয়ে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, করতে হয়। যতক্ষণ সমঅধিকার নিশ্চিত করা না হবে, ততক্ষণ নারীর সব বিষয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামনে আনতে হবে। দিবস উদযাপন প্রয়োজন, নারীর জন্য সর্বক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসন প্রয়োজন।’
নারীর কথা শুনতে কেউ আগ্রহী নয় উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নীতি নির্ধারক, রাষ্ট্র পরিচালনাকারী কেউই নারীর শুনতে চান না। যদি তারা শুনতে চাইতেন, তবে দেশের আইন নারীবিদ্বেষী হতো না, শিক্ষা ব্যবস্থা নারীবান্ধব হতো।’
তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন হলো, পুরুষরা বিরোধিতা করে বলতে শুরু করলেন সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। আমার প্রশ্ন হলো, ভূমির মামলাতে এ ধরনের সঠিক ব্যবহার না হওয়ার উদাহরণ নেই? তখন তো সেসব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। মোদ্দা কথা বাংলাদেশে নারীর স্থান কোথাও নেই। নারী যদি রাজনৈতিক দলের কেউ হন, তখনই কেবল তার একটু মান আছে, আর কারোর নেই। ফলে এই প্রশ্ন বাংলাদেশের মানুষ করবে। নারীর জন্য বিশেষ দিন এই কারণে দরকার, কারণ এই দিনটির জন্য সংগ্রাম করে নারী আজকের জায়গায় পৌঁছেছে। সেই ঘটনার একশ’ বছরে কী পরিবর্তন আনতে পেরেছে আমাদের নেতারা, যে নারীদের জন্য বিশেষ দিন লাগবে না। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে আমরা একসঙ্গে হই, একজন আরেকজনকে অ্যাপ্রিসিয়েট করি, নিজেদের ভবিষ্যত কাজের ক্ষেত্র তৈরি করি। এখন যদি কেউ বলতে চান, নারী না, মানুষ হন, তাদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, মানুষইতো ছিলাম। ‘হিউম্যান’ শব্দে নারী নেই, ‘হিউম্যান’ শব্দে শিশু নেই কিংবা অন্যান্য জেন্ডারের কথা ‘হিউম্যান’ বলে না। সে কারণে সবই আলাদা আলাদা করে বলতে বাধ্য হয়েছি। অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত নারী দিবস পালনে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-