ফের সক্রিয় পুরনো ঘাট ও দালালরাঃ টার্গেট রোহিঙ্গা

রফিকুল ইসলাম ◑
প্রায় প্রতি রাতে বঙ্গোপসাগরের কোন না কোন পয়েন্ট দিয়ে মাছ ধরার নৌকা, বোট বোঝাই করে লোক পাঠানো হচ্ছে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্য। গত কয়েক বছর পূর্বে সাগরে অসংখ্য মানুষের সলিল সমাধি ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নির্যাতনে গণকবরের সন্ধানে এ পথে বাংলাদেশীদের মালয়েশিয়া গমণ প্রায় বন্ধ ছিল।

তবে এ পথকে সহজ ভেবে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এতে এধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পাচার প্রতিরোধে কাজ করা দেশী-বিদেশী এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।

নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময় সমুদ্র শান্ত থাকে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে উখিয়া, টেকনাফ সহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলবর্তী ঘাটগুলোতে দালালরা সক্রিয় হয়ে উঠে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে পাচারের শিকার অসংখ্য মানুষের গণ কবরের সন্ধান মেলার পর কয়েক বছর অনেকটা নিস্ক্রিয় ছিল সমুদ্র পথে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার। উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অতি আগ্রহে সমুদ্র পথে মানব পাচারের পুরনো ঘাট ও দালালরা নতুনভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশী লোকজন সাগর পথে ঝুঁকি নিয়ে আর মালয়েশিয়া যেতে চায় না। তাই মানব পাচারে জড়িত দালালরা এবার টার্গেট করেছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদেরকে।

সর্বশেষ ১১ ফেব্রুয়ারী সকালে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের অদূরে দক্ষিণ- পশ্চিমে ছেঁড়াদ্বীপে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি মালয়েশিয়াগামী ফিশিং বোট ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ৭৩ জনকে জীবিত ও ১৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন। পরে বিচ্ছিন্নভাবে আরো কয়েকটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

একই সময়ে ২৩০ জন বোঝাই দুটি বোটের একটি ডুবে গেলেও অন্যটির খোঁজ মিলেনি। উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গাদের মধ্য বেশীর ভাগ নারী ও শিশু।

জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা দালালদের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন। তবে প্রায় সকলে নিজেদের উদ্যেগে দালালদের মাধ্যমে চরম ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পথে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পগুলো থেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল বলে রোহিঙ্গারা জানায়। তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছে বেশ কয়েকজন।

গত ১৫ ডিসেম্বর মিয়ানমার নৌবাহিনী তাদের গভীর সমুদ্র এলাকা থেকে ক্রুসহ ১৭১ জনকে আটক করেছিল। আটককৃতরা বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্প থেকে   ঝুঁকিপূর্ণ পন্থায় মালয়েশিয়া যাচ্ছিলো বলে জানা গেছে। আটক রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৮২ জন পুরুষ, ৬৯ জন মহিলা, ১৪ জন বালক, ৯ বালিকা ও ৭ ক্রু। গত এ ক’দিনে টেকনাফ উপকূল থেকে আরো কয়েকদফা মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করার খবর পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্র মতে, গত ৭ বছরে ২ হাজার ৭৩৫ বাংলাদেশি সাগর পথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যরে বিভিন্ন কারাগারে আটকা পড়ে আাছে ১০ হাজারের বেশী। এদের মধ্য ৬ হাজার ৩৭০ জনই শিশু ও নারী।

সাগর শান্ত থাকায় দালালরা নৌকায় করে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এদিকে এমন আশংকা কঠোর হস্তে প্রতিরোধ করার জন্য স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপকুলীয় এলাকাগুলোতে কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অতি আগ্রহে টার্গেট করেছে পাচারকারী দালাল চক্রের সদস্যরা।
তারা প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে। এর আগেও একাধিক সময় টেকনাফ সাগর উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার চলছিল। তবে সেসময় রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাংলাদেশী মানুষের সংখ্যাও ছিল চোঁখে পড়ার মত।

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা যুবতী সানজিদা বেগম বলেন, মালয়েশিয়াতে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। মালয়েশিয়া অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সাথে বিয়ে দিতে দালালরা সুন্দরী যুবতীদের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাচার করছেন।

এছাড়া অনেক বিবাহিত নারীও তাদের শিশু সন্তানসহ সেখানে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য দালালদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন। উখিয়ার তাজনিমার খোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুল নবী মত প্রকাশ করে বলেন,আগে স্থানীয় দালালদের সহযোগীতায় অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট তৈরী করে বাংলাদেশী সেজে আকাশপথে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি রোহিঙ্গারা যেন কোন পাসপোর্ট করতে না পারে সেই বিষয়ে সরকার কঠোর নজরদারী বৃদ্ধি করেছে। ফলে অবৈধ ভাবে সাগর পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যেতে রাজি হচ্ছে তারা।

তিনি আরো বলেন, প্রতিটি ক্যাম্পে মালয়েশিয়া পাচারকারী দালাল চক্রের সদস্যরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দালালরা প্রথমে কম টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও পরে মাঝপথে গিয়ে স্বজনদের কাছে পৌঁছানোর আগে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। এই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে দালালরা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়া মানব পাচারে সক্রিয় ভাবে জড়িত রোহিঙ্গা দালাল চক্র। তাদের সাথে এই অপকর্মে স্থানীয় কিছু অর্থলোভী অসাধু ব্যক্তিও জড়িত রয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, বাংলাদেশ থেকে সমুদ্র পথে মানব পাচার প্রায় কমে এসেছিলো। কিন্তু বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যে যেভাবে পারছে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে। উখিয়া সুজনের সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, এতগুলো আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সামলানো কঠিন। তাছাড়া তাদের মধ্যে অধিকাংশ মালয়েশিয়ায় বিয়ে করতে বা স্বামীর নিকট যাচ্ছে।

হেলপ কক্সবাজার এনজিওর চেয়ারম্যান এমএ কাসেম বলেন রোহিঙ্গাদের মাঝে যেসব এনজিও বা সংস্থা পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে তারা কোনভাবে এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ এ খাতে ব্যয় করা হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর পরও সমুদ্র পথে মানব পাচার কমছে না বরং বেড়েই চলেছে।

উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে মানব পাচারের বদনাম থেকে বাংলাদেশ বের হতে পারছে না। তিনি বলেন, অন্তত ডজনের বেশি দেশী-বিদেশী সেবা ও সাহায্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের মাঝে পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে। মানব পাচার প্রতিরোধে গত দুই বছরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। যা কোন কাজে আসছে বলে মনে হয় না।

আরও খবর