ইয়াবার কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারঃ শীর্ষে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পা হারানো টেকনাফের ইসমাইল

সমকাল ◑

মোহাম্মদ ইসমাইল। চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি। বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফের লামার বাজারে। সেখান থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা সরবরাহ করে। প্রায় চার বছর আগে ইয়াবা পাচারের সময় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একটি পা হারিয়েছে। এর পরও ইয়াবা ব্যবসা ছাড়েনি। কৃত্রিম পা লাগিয়ে চলাফেরা করে সে। মাদক ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছে। বিদেশে তার কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সে বিষয়ে খুব শিগগির তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি ইসমাইলসহ টেকনাফে পুলিশের কাছে ২১ চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছে। অন্য ২০ জনেরও বিদেশে কোনো সম্পদ আছে কিনা, সে বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে সিআইডি। অবশ্য গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারে আত্মসমর্পণ করা ১০২ জন মাদক কারবারির মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে কোনো তথ্য এখনও সামনে আনতে পারেনি পুলিশ। তবে সিআইডির বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, ১০২ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। নিশ্চিত হতে সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে।

২০১৮ সালের মে থেকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। মাদককে জিরো টলারেন্সে আনতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে জোরালো অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্নিষ্টরা। অভিযানে র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে মাদক কারবারিদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনাও ঘটছে। এরপরও থেমে নেই মাদক কারবারিরা। নানা কৌশলে তারা পাচার করছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। ধরাও পড়ছে বিভিন্ন সময়। ইয়াবা আসছে মূলত মিয়ানমার থেকে। অভিযানের মধ্যে গত বছরের শুরুতে কক্সবাজার-টেকনাফের ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে কক্সবাজারের চিহ্নিত ১০২ মাদক কারবারি একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। পরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও একাধিক মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করে।

সর্বশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফে ২১ চিহ্নিত মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেছে পুলিশের কাছে। তারা হলো- টেকনাফের লামার বাজারের আবদুল জলিলের ছেলে মোহাম্মদ ইসমাইল, উত্তর লম্বরীপাড়ার জহির আহমদের ছেলে তৈয়ুব ওরফে মধু তৈয়ুব, মৌলভীপাড়ার আবুল কালাম ওরফে কালা সওদাগর, রিদোয়ান, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল আমিন ওরফে আবুল, বশির আহম্মদ, রাশেল ওরফে হাজি রাশেল, ফজল করিম, মাঠপাড়া বিজিবি ক্যাম্প এলাকার জাহেদ উল্লাহ, লেজিরপাড়ার ইদ্রিস, খয়রাতিপাড়ার সাদ্দাম, সিকদারপাড়ার আবদুল গফুর, হোসেন ওরফে কালু, পুরাতন পল্লানপাড়ার আবদুল নূর, ফুলের ডেইল এলাকার নুর মোহাম্মদ, সিকদারপাড়ার ইমাম হোসেন, উলুচামারী কোনারপাড়ার মিজানুর রহমান, হোয়াইক্যং উত্তরপাড়ার ফরিদ আলম, ঝিলংজা পশ্চিম লারপাড়ার ইমাম হোসেন ও মহেশখালিয়াপাড়ার শাহাদত হোসাইন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইসমাইল একজন বড় ধরনের ইয়াবা কারবারি। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা করে আসছিল। পাশাপাশি সে অন্য ইয়াবা কারবারিদের টাকা মিয়ানমারে হুন্ডি করত। তার মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে অন্য মাদক কারবারিরা। এ ছাড়া সেও বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। টেকনাফ পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ইসমাইলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ইয়াবা কারবারি টিটি জাফর দুবাইয়ে বসে টেকনাফের ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করে। জাফরের কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা  পাচার করেছে ইসমাইল। মাদকের টাকায় আলিশান বাড়ি গড়েছে টেকনাফে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারেও তার বাড়ি রয়েছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। প্রায় চার বছর আগে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় সে। পরে সেই পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু এরপরও ইয়াবার কারবার ছাড়েনি সে। কৃত্রিম পা লাগায়। তার ছোট ভাই ইয়াছিনও এলাকার চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি ছিল। কয়েক বছর আগে ইয়াছিন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে। আত্মসমর্পণ করা আরেকজন তৈয়ুব ওরফে মধু তৈয়ুবের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে। অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে ইয়াবার টাকায়।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন সমকালকে বলেন, আত্মসমর্পণ করা ২১ জনের মানি লন্ডারিং বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে কিনা, যদি করে থাকে কী পরিমাণ টাকা পাচার করেছে এবং বিদেশে কী পরিমাণ সম্পদ গড়েছে- এসব বিস্তারিত খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস সমকালকে বলেন, ইসমাইলের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, মাদক ও অস্ত্র আইনসহ আটটি মামলা রয়েছে। তৈয়ুবের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। ইসমাইল-তৈয়ুবসহ আত্মসমর্পণ করা ২১ জনই চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি। অস্ত্র ও মাদক মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন।

আরও খবর