বাংলা ট্রিবিউন ◑
নিরাপদ জীবনের কথা ভেবে মালয়েশিয়ায় থাকা রোহিঙ্গা ছেলেদের সঙ্গে মোবাইলে বিয়ে করছেন কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারীদের অনেকেই। এরপর স্বামীর কাছে পৌঁছাতে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সাগরপথ বেছে নিচ্ছে তারা। এসময় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতেও ধরা পড়তে হচ্ছে তাদের। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর ফের সাগরপাড়ির চেষ্টা করছে তারা। ফলে আগের নাম বদলাতে হচ্ছে। নতুন নাম ধারণ করে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহতই থেকে যাচ্ছে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে সেন্টমার্টিনের কাছে ট্রলারডুবিতে উদ্ধার রোহিঙ্গা নারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সেদিনের ঘটনায় উদ্ধার একজন রোহিঙ্গা নারীর নাম রজুমা আক্তার (১৯)। উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা সে। এর আগেও একবার আটক হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ২০১৯ সালে ৩ এপ্রিল টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়া উপকূল দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতিকালে বিজিবির হাতে আটক হয়েছিল রজুমা। তখন সে নিজেকে তাহামিনা বেগম বলে পরিচয় দেয়। সেসময় তার সঙ্গে আরও ২৬ জন যাত্রী ছিল।
গত মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) মালয়েশিয়াগামী ট্রলারডুবিতে বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া একাধিক রোহিঙ্গা নারী জানায়, পাচারকারীরা সেদিন দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাকে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য সাগরপাড়ের একটি পাহাড়ে একত্রিত করেছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল নারী। তারা অনেকেই বিয়ের পাত্রী। মালয়েশিয়ায় স্বামী কাছে যাচ্ছিলো তারা।
ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা তরুণী আসমা তারা (১৭)। সে এখন টেকনাফের লেদা শরণার্থী ক্যাম্পে নিজের শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করছে। তার সঙ্গে কথা হয় সেখানে। আসমা বলেছে, ‘মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী এক রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে প্রায় দুই বছর আগে মোবাইলে বিয়ে হয় আমার। তখন থেকেই স্বামীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুশিডং জেলা থেকে ২০১৭ সালের শেষভাগে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা আসমা আরও জানায়, তার মতো আরও কয়েকজন মোবাইল ফোনে বিয়ে করা স্বামীর কাছে যাচ্ছিলো। আসলে সবাই এই শিবিরের বন্দি জীবন থেকে মুক্তি চায়।
সেদিন তার সঙ্গে নজিবা নামের এক নারীও মালয়েশিয়া যাচ্ছিলো জানিয়ে আসমা বলেছে, ‘নজিবারও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে। সেও স্বামীর কাছে যাচ্ছিলো। ট্রলারডুবির পর তাকে আর খুঁজে পাইনি। উদ্ধার হওয়া সবগুলো মৃতদেহ দেখেছি। সেখানে তার লাশ ছিল না।’
ট্রলার ডুবির ঘটনায় আসমা ছাড়াও লেদা শরণার্থী শিবিরের আরও সাত জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের সবাই পরিবারের কাছে ফিরে এসেছে জানিয়ে আসমা বলেছে, ‘বেশিরভাই বিয়ে করে বা করার উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলো। অনেকে এর আগেও এই পথ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছিল।’
আসমা এর আগেও দুইবার অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছে বলে জানিয়েছে টেকনাফের লেদা নতুন শিবিরের মাঝি (নেতা) আবু বক্কর। তিনি বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই বিদেশে থাকা রোহিঙ্গা পাত্রের সঙ্গে মোবাইল ফোনে বিয়ে হচ্ছে ক্যাম্পের নারীদের। বিয়ের পর স্বামীরা তাদের নেওয়ার চেষ্টা করে।’
আবু বক্কর আরও বলেন, ‘ট্রলারডুবির ঘটনায় আমার শিবিরের সাত জনকে পাওয়া গেছে। তবে তারা আসল পরিচয় লুকিয়ে ওই ট্রলারে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিলো। তাদের মধ্যে এর আগেও দুবার অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এমন নারীও ছিল।’
এই ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা যুবক বলেছে, ‘বাংলাদেশে আসার পরে কর্মহীন দিন যাচ্ছে। ঘরে আমি ছাড়া সবাই নারী সদস্য। তিন বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু টাকার অভাবে তাদের বিয়ে দিতে পারছি না। তাদের কথা চিন্তা করে উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে এক মাস আগে টেকনাফের রাজারছড়া উপকূল থেকে রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসতে হয়েছে। আমার সঙ্গে এক বড় বোনও ছিল। মালয়েশিয়া অবস্থানকারী এক মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ফলে তাকে নিয়ে সেখানে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু হয়নি।’ তবে সময় সুযোগ হলে সে আবারও সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে ইচ্ছুক বলেও জানিয়েছে।
র্যাব-১৫ এর টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, ‘যেসব দালাল (পাচারকারী) জামিনে বেরিয়ে আসে, তাদের নজরদারিতে রাখছে র্যাব। পাচারকারীরা রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে টার্গেট করছে। যেসব পাচারকারী এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে, তাদের ধরতে র্যাবের একটি বিশেষ টিম কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-