বার্তা পরিবেশক ◑
কক্সবাজার শহরের ১নং ওয়ার্ডে সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরারটেক এলাকায় এক নামে পরিচিত তিনি। থানা পুলিশের কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ট লোক পরিচয় দিয়ে প্রতিনিয়ত নিরীহ মানুষকে হয়রানি করেন। জিম্মি করে আদায় করেন মোটা অংকের টাকা। তার হয়রানির শিকার হয়ে পথে বসেছে অনেক লোক।
থানা পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ট এই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ ফারুক। ফারুকের আবার পরিচয় অনেক। কখনও মাছ ধরার ট্রলারের মাল্লা, কখনও গার্মেন্টস কর্মী, কখনও টমটম চালক, কখনও নাইটগার্ড, আদালত পাড়ার মুন্সি, কখনও বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ নেতা, কখনও মানবাধিকার কর্মী, আবার মাঝে মাঝে সাংবাদিকও পরিচয় দিয়ে বেড়ান। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তিনি খোলস পাল্টান। পরিচয় বদলের দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় তার কাছে হয়রানির শিকার হয়েছেন বহু নিরীহ মানুষ। কখনও চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে, কখনও আদালত থেকে জামিন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে, কখনও পুলিশের হয়রানির ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়সহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফারুকের বাড়ি কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের বিন্দাপাড়া গ্রামে। তার পিতার নাম শামশুল আলম। বিগত ২০১৬ সালেও তিনি কুতুবদিয়া পাড়ার মিরাজু বাপের মালিকানাধীন এফবি শাহ জব্বার নামে একটি মাছ ধরার ট্রলারে জেলে হিসেবে কাজ করতেন। এছাড়াও নাইট গার্ড হিসেবে কাজ করেছেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। কিন্তু ফারুকের সেই দিন বদলে গেছে। তিনি এখন নিজের মোটর সাইকেলের সামনে ও পেছনে বড় হরফে ‘সাংবাদিক’ লিখে শহরে দাপিয়ে বেড়ান। রাজনৈতিক ও বন্ধু মহলে পরিচয় দেন বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কক্সবাজার জেলার একাংশের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দলের বড় নেতা পরিচয় দিলেও ফারুকের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, তিনি এসএসসিও পাশ করেননি।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) কক্সবাজার অফিস সূত্রে জানা যায়, ফারুক ২০১৮ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় টিউটোরিয়াল সেন্টারে এসএসসি প্রোগ্রামের নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছেন। তার শিক্ষার্থী নাম্বার ১৮-০-১০-৭৭১-০০১। বাউবি অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, তিনি ২০১৮ সালে ভর্তি হলেও ২০১৯ সালের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি।
২০০৯ সালে কুতুবদিয়াপাড়ার মাহমুদুল করিম মাঝু নামে ট্রলারের এক মাঝির কাছ থেকে জেলে (মাল্লা) হিসেবে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ৭০ হাজার টাকা অগ্রীম নেন। কিন্তু প্রতারক ফারুক আর সাগরে যাননি। পুরো টাকাই মেরে দেন। পরে মাহমুদুল করিমের বাবা জামাল মাঝি বাদী হয়ে প্রতারণার অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানেও প্রতারণা মামলাটি চলমান আছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী মাহমুদুল করিম মাঝু।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমিতি পাড়ার অনেকেই অভিযোগ করে জানিয়েছেন, ফারুক নিজেকে সিনিয়র সাংবাদিক, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদক এবং কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্টজন বলে পরিচয় দেন সর্বত্র। তিনি লোকজনকে বলে বেড়ান, সদর থানার কর্মকর্তারা তাকে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের অপরাধীদের তালিকা করতে বলেছেন। সেই তালিকায় যাদের নাম আসবে তাদের রক্ষা নেই। চাহিদামত টাকা দিলে তালিকায় নাম আসবে না। এভাবে পুলিশের ভয় দেখিয়ে তিনি এলাকার সৎ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পর্যন্ত টাকা হাতিয়ে নেন। প্রতি মাসে মাসোহারা আদায় করেন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও।
এবিষয়ে সদর থানার ওসি শাহজাহান কবির বলেন, “ফারুক নামে কাউকে আমি চিনিনা। কাউকে কোন দায়িত্বও দেওয়া হয়নি। খোঁজ খবর নিয়ে এই প্রতারককে আইনের আওতায় আনা হবে।”
ফারুকের ঘনিষ্টজনেরা জানান, ফারুক ২০০৮ সালের দিকে জীবিকার তাগিদে এবং ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় কুতুবদিয়া থেকে কক্সবাজার শহরে আসেন। প্রথমে কক্সবাজার পৌরসভার সমিতি পাড়া এলাকায় একটি চায়ের দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন কুতুবদিয়া পাড়ায়। পরে কিছুদিন টমটম চালান শহরে। ওই সময় চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে তিনি পালিয়ে যান চট্টগ্রামে। সেখানেও মাছ ধরার ট্রলারের জেলে হিসেবে কাজ করেন প্রায় দুই বছর। ২০১৪ সালের দিকে তিনি পূণরায় কক্সবাজার শহরে এসে বাসা ভাড়া নেন কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সংলগ্ন গ্যাস পাম্পের পাশে। আপন ভাইদের সাথে আবারও কাজ শুরু করেন মাছ ধরার ট্রলারে। ট্রলারে জেলে হিসেবে কাজ করার সুবাদে মানবপাচারেও জড়িয়ে পড়েন। ২০১৬ সালে এ বিষয়ে স্থানীয় পত্রিকায় সৈনিক লীগ নেতা ফারুক হিসেবে তার নাম এসেছিল।
২০১৬ সালে ফারুকের এক ভাই হারুন হঠাৎ সাগরে নিখোঁজ হয়ে যান। হারুন কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও সোনাদিয়া উপকূলে জলদস্যু হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সূত্রে জানা যায়, হারুনের নামে ফিশিং ট্রলার ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে। ভাইয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে কক্সবাজার শহরে কর্মরত কিছু সাংবাদিকের সাথে পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে উঠে ফারুকের। এরপর স্বপ্ন দেখেন সাংবাদিক হয়ে উঠার। পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজেকে শিক্ষিত হিসেবে উপস্থাপন করে তিনি স্থানীয় একটি পত্রিকায় শিক্ষানবীশ রিপোর্টার হিসেবেও কাজ করার সুযোগ পান। তখন থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সাংবাদিকতার সেই পরিচয়কে ব্যবহার করেন অপরাধের ঢাল হিসেবে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে কিছুদিন তিনি আদালত পাড়ায় মুন্সি হিসেবেও কাজ করেছেন। বর্তমানে দৃশ্যমান কোন ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকলেও রাজার হালে চলাফেরা করেন। দামি মোটর সাইকেল, দামি মোবাইলসহ আলিশান চলাফেরা করেন।
সমিতি পাড়া বাজারের ফল বিক্রেতা এনাম অভিযোগ করে বলেছেন, “কিছুদিন আগে ফারুক এসে আমাকে ধমক দিয়ে বলে, তুই অবৈধ ব্যবসা করিস। ওসি সাহেব তোর বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছেন। কিছু টাকা পয়সার ব্যবস্থা কর। অন্যথায় ঝামেলায় পড়বি”।
ভুক্তভোগী অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা অনেকেই ফারুকের চাঁদাবাজি, হয়রানি এবং বিভিন্ন অপকর্মের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে তার (ফারুক) বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগ দিয়েছেন।
বাসিন্যা পাড়ার বেবী আক্তার জানান, ফারুক ২০১৬ সালে তার ভাই এবং বাবাকে মামলা থেকে জামিন করিয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। পরবর্তীতে ভাইয়ের জামিন হলেও তার বাবার কোন খোঁজ পাননি। এ বিষয়ে ফারুকের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাদেরকে উল্টো পুলিশের ভয় দেখান।
ফারুকের নিজের ফেইসবুক পেইজে নিজেকে কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিটির অর্থ সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিটির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, ফারুক ইতিপূর্বে কিছুদিন সাংবাদিক ইউনিটির সাথে জড়িত থাকলেও সম্প্রতি তাকে কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ফারুক দৈনিক আপনকন্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয়ে মানুষজনকে হয়রানি করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এম ওসমান গণি জানান, ফারুক নিজেকে আপনকন্ঠের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে মানুষকে হয়রানি করছেন বলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ এসেছে।
ফারুককে আমরা শিক্ষানবীস রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলাম। তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় তাকে পত্রিকা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সে যদি পত্রিকার নাম ভাঙ্গিয়ে কোন অপকর্ম করে তার দায়ভার পত্রিকা কর্তৃপক্ষ নেবে না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক বলেন, তার বিরুদ্ধে কিছু লোক ষড়যন্ত্র করছে। অভিযোগের বিষয়ে তার কোন মন্তব্য নেই বলে তিনি জানান। /দৈনিক কক্সবাজার
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-