টেকনাফের আরও অর্ধশতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্প ২৯ জানুয়ারি: থাকছেন যারা

বিশেষ প্রতিবেদক ◑

কক্সবাজারের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ ইয়াবা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে। অভিযানে ধরা পড়ছে ছোট–বড় ইয়াবার চালান। কিন্তু ইয়াবার বেচা–বিক্রি থামছে না কিছুতেই। টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির ১৮টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ইয়াবা। এরই মধ্যে দ্বিতীয় দফায় টেকনাফের আরও অর্ধশতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন।

কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, চলতি জানুয়ারির ২০ দিনে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি ইয়াবা বড়ি। এ সময় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ৯ জন রোহিঙ্গা।

গত ডিসেম্বরে উদ্ধার করা হয় ২৭ লাখ ৩৫ হাজার ইয়াবা বড়ি। এ সময় ৯৮ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ৪৫ জনই রোহিঙ্গা। এর আগে নভেম্বর মাসে জব্দ করা হয় ৬ লাখ ৫৫ হাজার ১৪টি ইয়াবা। টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির ১৮টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ইয়াবা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকে জড়িত। সেখানকার ৩৭টি কারখানায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। এখন ব্যবসা ধরে রাখতে তারা বাকিতে ইয়াবা দিচ্ছে। সেই ইয়াবার ঢল থামানো মোটেই সহজ কাজ নয়।

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপে পড়ে অথবা প্রাণ বাঁচাতে ১১ মাস আগে (২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি) টেকনাফের শীর্ষ ১০২ ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তখন ধারণা করা হয়েছিল, এবার ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হবে। কিন্তু তা হয়নি, বরং বেড়েছে। এখন বাকিতে পাওয়া ইয়াবা নিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।

দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণ

দ্বিতীয় দফায় টেকনাফের আরও অর্ধশতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের অনেকে পুলিশের হেফাজতে চলে গেছেন। ২৯ জানুয়ারি টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের মাঠে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। তাঁরা সবাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী।

পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের হাতে সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা ও ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় দফায় আরও অর্ধশতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ চাইছেন। এ সুযোগ তাঁদের দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৩০ জনের বেশি ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের হেফাজতে চলে এসেছেন।

তবে এ তালিকায় প্রভাবশালী কারও নাম নেই। তালিকায় আছেন টেকনাফের ডেইলপাড়ার রেজাউল করিম, মো. শরিফ ও মো. শফিক, সদর উপজেলার হাবিরছড়ার ফরিদ আলম, নুর কামাল, সাবরাং ইউনিয়নের বাজারপাড়ার আবদুর রহিম।

রেজাউল করিমের বাবা আবদুল করিম বলেন, ‘তাঁর ছেলে জীবনেও ইয়াবা ব্যবসা করেনি। কিন্তু মাদকের তালিকায় তার নাম উঠে গেছে। বিপদ থেকে রক্ষা করতে তাকে আত্মসমর্পণ করাচ্ছি।’

আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক এক তরুণ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেই দুই বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। তাই প্রাণরক্ষার স্বার্থে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের চেষ্টা করছি।’

জেলা পুলিশের তথ্যমতে, জেলার আটটি উপজেলায় ইয়াবা ব্যবসায়ী আছেন ১ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে টেকনাফে ৯১২ জন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা তালিকায় কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি আছেন ৭৩ জন। তাঁদের মধ্যে ২৪ জন প্রথম দফায় আত্মসমর্পণ করেন। এই ২৪ জনের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফের বিতর্কিত সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির চার ভাই আবদুল শুক্কুর, আবদুল আমিন, মো. শফিক ও মো. ফয়সাল। আছেন বদির ফুফাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল, ভাগনে সাহেদুর রহমান নিপুসহ ১৬ জন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সব তালিকায় ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে আবদুর রহমান বদি ও তাঁর পাঁচ ভাই, এক বোনসহ ২৬ জন নিকটাত্মীয়ের নাম আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বদি আত্মসমর্পণ করেননি।

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। চলমান অভিযানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪৮২ জন।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসা অনেক কমে এসেছে। কিন্তু নৌপথে ইয়াবা চোরাচালান থামানো যাচ্ছে না। এখন দ্বিতীয় দফায় অর্ধশতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসমর্পণ শেষ হলে মাদক ব্যবসা আরও কমে আসবে।

পুলিশ জানায়, প্রথম দফায় আত্মসমর্পণ করা ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর মধ্যে ১০১ জনের বিরুদ্ধে ১১ মাস পর গত সোমবার কক্সবাজার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।

প্রসঙ্গত,২০১৯ সালের ১৬ ফ্রেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারীর উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে ১০২ জন তালিকাভুক্ত ইয়াবাকারবারি আত্মসমর্পণ করে।

এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির আপন চার ভাইসহ ঘনিষ্ঠ আট আত্মীয় ছিল। অনুষ্ঠান শেষে ওই দিনই দুটি মামলায় আটক দেখিয়ে আত্মসমর্পণকারীদের কক্সবাজার কারাগারে পাঠানো হয়। ১০২ ইয়াবা ব্যবসায়ীর মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই টেকনাফের বাসিন্দা।

তারা হলো- টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে দানু মেম্বার, শাহপরীর দ্বীপের রেজাউল করিম মেম্বার, সামশু মেম্বার, সাহেদ রহমান নিপু, সাহেদ কামাল, নুরুল আমিন, আলী আহমদ, মৌলভী বশির, হোসেন আহমদ, শওকত আলম, রাসেল, ডেইল পাড়ার নুরুল আমিন, মুন্ডার ডেইলয়ের মনজুর, আলীর ডেইলের জাফর আহমদ, আবদুল হামিদ, শামীম, দক্ষিণ নয়াপাড়ার নূর মোহাম্মদ, আলমগীর ফয়সাল, ডেইল পাড়ার মো. সাকের মিয়া, নয়াপাড়ার মো. তৈয়ব, টেকনাফ পৌর এলাকা ও সদর ইউনিয়নের আবদু শুক্কুর, আমিনুর রহমান ওরফে আবদুল আমিন, দিদার মিয়া, আবদুল আমিন, নুরুল আমিন, শফিকুল ইসলাম সফিক, ফয়সাল রহমান, আবদুর রহমান, জিয়াউর রহমান,

পৌর কাউন্সিলর নুরুল বশর ওরফে নুরশাদ, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার ইমাম হোসেন, বড় হাবিব পাড়ার ছিদ্দিক, পুরনো পল্লানপাড়ার শাহ আলম, অলিয়াবাদের মারুফ বিন খলিল বাবু, মৌলভী পাড়ার একরাম হোসেন, মধ্যম ডেইল পাড়ার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, চৌধুরী পাড়ার মংমং ছেং ওরফে মমচি ও দক্ষিণ জালিয়া পাড়ার জুবাইর হোসেন, মধ্যম জালিয়া পাড়ার মোজাম্মেল হক, ডেইল পাড়ার আবদুল আমিন, নাজির পাড়ার এনামুল হক মেম্বার, ভুট্টোর ভাগিনা আফসার, আবদুর রহমান, সৈয়দ হোসেন, মো. রফিক, মো. হেলাল, জামাল হোসেন, মৌলভী পাড়ার মো. আলী, নাইটং পাড়ার মো. ইউনুস, উত্তর লম্বরীর আবদুল করিম ওরফে করিম মাঝি, সদর কচুবনিয়ার বদিউর রহমান, রাজার ছড়ার আবদুল কুদ্দুস, জাহালিয়া পাড়ার মো. সিরাজ, নতুন পল­ানপাড়ার মো. সেলিম,

নাইট্যং পাড়ার মো. রহিম উল্লাহ, চৌধুরী পাড়ার মোহাম্মদ আলম, তুলাতলীর নুরুল বশর, হাতিয়ার ঘোনার দিল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ হাছন, রাজার ছড়ার হোসেন আলী, উত্তর জালিয়াপাড়ার নুরুল বশর মিজি, আবদুল গণি, জালিয়াপাড়ার মো. হাশেম, পুরান পল্লানপাড়ার ইসমাইল, নাইট্যংপাড়ার আইয়ুব, নুর হাবিব, মাঠপাড়ার কামাল, শিলবনিয়াপাড়ার আয়ুব, জালিয়াপাড়ার আলম, নুরুল আলম, বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজ পুরার নুরুল আলম, শামলাপুর জুমপাড়ার শফি উল্লাহ, ছৈয়দ আলম, উত্তর শীলখালীর মো. আবু ছৈয়দ, হ্নীলা ইউনিয়নের হ্নীলা পশ্চিম লেদার নুরুল হুদা মেম্বার, আলী খালীর জামাল মেম্বার, শাহ আজম, পশ্চিম সিকদারপাড়ার ছৈয়দ আহমদ, রশিদ আহমদ, পশ্চিম লেদার নুরুল কবীর, পূর্ব লেদার জাহাঙ্গীর আলম, জাদিমোরার মোহাম্মদ হাসান আবদুল্লাহ, লেদার ফরিদ আলম, মো. হোছন, জহুর আলম, আবু তাহের, বোরহান, হামিদ, রবিউল আলম, আলীখালীর হারুন, হ্নীলা পশ্চিম সিকদার পাড়ার মাহাবুব, বাজারপাড়ার মো. শাহ, পূর্ব পানখালীর নজরুল ইসলাম, পশ্চিম পানখালীর নুরুল আবছার, ফুলের ডেইলের রুস্তম আলী, আলী নেওয়াজ, আবু তৈয়ব ও রমজান ও কক্সবাজারের শাহজাহান আনসারী।

আরও খবর