ব্লু-ইকোনমিতে খুলতে পারে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার:

কেয়ায় ক্যান্সার, মৃগীরোগ, ডায়াবেটিসসহ ১৬ রোগের প্রতিষেধক!

আহমদ গিয়াস ◑

বালির বন্ধন তৈরি, মাটির ক্ষয়রোধ ও সামুদ্রিক বাতাসের তীব্র প্রবাহ ঠেকাতে ভূমিকার কারণে উপকূলীয় অঞ্চল সুরক্ষায় কেয়াগাছের গুরুত্ব বাস্তুশাস্ত্র বা পরিবেশ বিজ্ঞানে অপরিসীম। এই কেয়াগাছের বনই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির জনবসতি রক্ষা করে চলেছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দারাও এটা মনে করেন। বাস্তুসংস্থান কার্যক্রম ছাড়াও কেয়াগাছের রয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান পুষ্টি ও ঔষধিগুণ।

সাম্প্রতিককালে এর ঔষধিগুণ কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি করা হচ্ছে দুরারোগ্য মৃগীরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ অন্তত ১৬টি রোগের প্রতিষেধক। তাই বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশের ব্লু-ইকোনমি তথা সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতিতেও কেয়াগাছ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা। উপকূলের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ হিসাবে বাস্তুতন্ত্রে কেয়াগাছের (প্যান্ডানাস বা স্ক্রুপাইন) গুরুত্ব নিয়ে বিশ্বের বহু দেশে গবেষণা হয়েছে। তবে এর পুষ্টিগুণ, ঔষধিগুণ ও উদ্ভিদ রসায়ন নিয়ে গবেষণা হয়েছে ৫/৬ বছর আগে ভারতে।

ভারতের তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় এর ঔষধিগুণ, পুষ্টিগুণ ও রসায়নগুণ উন্মোচন করা হয়। ২০১৪ সালের জুনে এই গবেষণা তথ্য আন্তর্জাতিক একাডেমির স্বীকৃতি পায়।

ভারতের পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়ওয়ান্ত্র সাওয়ান্ত কলেজ অফ ফার্মেসি অ্যান্ড রিচার্সের ফার্মাকোলজি বিভাগ, তামিলনাড়ুর বিনয়কা মিশন বিশ্ববিদ্যালয় ও গহলট ফার্মেসি ইনস্টিটিউটের ফার্মাসিউটিক্যাল মেডিসিনাল কেমিস্ট্রি বিভাগের ওই গবেষণা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কেয়াগাছের বিভিন্ন অংশ থেকে তৈরি করা হচ্ছে মৃগীরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ অন্তত ১৬টি রোগের প্রতিষেধক।

গবেষণায় বলা হয়, এথনো ফার্মাকোলজি বা রোগের প্রতিষেধক হিসাবে কেয়াগাছের ঐতিহ্যগত ব্যবহার ভারতীয় উপমহাদেশের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে পাওয়া যায়। কেয়াগাছের বিভিন্ন অংশ থেকে মাথাব্যথা, বাত, কৃশ, ঠান্ডা, ফ্লু, মৃগীরোগ, ক্ষত, ফোঁড়া, চুলকানি, লিউকোডার্মা, আলসার, শ্বাসনালী প্রদাহ, হেপাটাইটিস, শৃঙ্গ, কুষ্ঠরোগ, সিফিলিস ও ক্যান্সারের প্রতিষেধক তৈরি করা হয়। এছাড়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ডাইসুরিক এবং অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসাবেও এর ব্যবহার রয়েছে। এর উদ্ভিদ রসায়ন (ফাইটোকেমিক্যালস) লিগানানস এবং আইসোফ্লাভোনস, কমমেস্ট্রল, ক্ষারক, স্টেরয়েড, শর্করা, ফেনলিক যৌগ, গ্লোকোসাইড, প্রোটিন, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন সি, বি ১, বি ২, বি ৩সহ আরো কিছু পুষ্টিকর উপাদানে ভরপুর।

পুষ্টির ক্ষেত্রে এর অপরিসীম গুরুত্ব তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি ১০০ গ্রাম বিশিষ্ট কেয়া ফল মূলত জল এবং কার্বোহাইড্রেটের (৮০ এবং ১৭ গ্রাম শ্বাস) সমষ্টি।

এছাড়া এতে প্রোটিন রয়েছে ১.৩ মিলিগ্রাম, ফ্যাট ০.৭ মিলিগ্রাম এবং ফাইবার ৩.৫ গ্রাম (সমন্বিত)। পান্ডানাস ফুলে ২.২ গ্রাম প্রোটিন, ১৩৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১০৮ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৫.৭ মিলিগ্রাম আয়রন, ০.০৪ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি এবং বিপুল পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন (১৯ থেকে ১৯,০০০ মাইক্রোগ্রাম) রয়েছে। কেয়া ফল থেকে জুসও তৈরি করা হয় বিভিন্ন দেশে। তবে কেয়াগাছের দ্বীপ নামে পরিচিত কক্সবাজারের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের চারপাশে হাজার হাজার কেয়াগাছ থাকলেও এর ঔষধি ও পুষ্টিগুণ এখানে কাজে লাগানো হয় না।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মৌলভী ফিরোজ খান জানান, একসময় দ্বীপের বাসিন্দারা ঘরের ছাউনি হিসাবে কেয়াগাছের পাতা, দড়ি হিসাবে এর শেকড় এবং খুঁটি ও অন্যান্য কাজে এর কাণ্ড ব্যবহার করত। কিন্তু গত প্রায় তিন দশকে এ দ্বীপে পর্যটন শিল্পের বিকাশের কারণে কেয়াগাছের ব্যবহার অনেকাংশেই কমে গেছে। শিশুরা কৌতূহলবশত কেয়া ফলের শ্বাস খেলেও বর্তমানে এর কোনো বাজারমূল্য নেই। দ্বীপের বাসিন্দারা কেবল অবিচল সামুদ্রিক বায়ু ঠেকাতে ও সামুদ্রিক জোয়ার থেকে মাটির ক্ষয়রোধে কেয়া বনের ব্যবহার করছে।

বাস্তুশাস্ত্রে কেয়া বনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে, কেয়া সমুদ্র উপকূলে ভেসে আসা আলগা বালির বন্ধন তৈরি, মাটির ক্ষয়রোধ ও বাতাস বিরতি হিসাবে কাজ করে। উচ্চ লবণাক্ততা ও খরা এবং জলাবদ্ধতা সহনশীল কেয়াগাছ তীব্র লবণযুক্ত বাতাসের ঝাপটা ও বালির বিস্ফোরণেও টিকে থাকে। উচ্চ মাত্রার সৌর বিকিরণের জন্যও কেয়াগাছ সহনশীল। এ কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের সুরক্ষায় কেয়াগাছ ‘মাল্টিস্পেসিজ বায়োশিল্ডের’ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে।

গবেষকরা মনে করছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের চারদিকে কেয়াগাছ থাকায় ভেতরের অংশে নারকেল, তুলাসহ শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে এক স্বতন্ত্র বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠেছে, যার কারণে এর জীববৈচিত্র্য এত সমৃদ্ধ।

দ্বীপের বাসিন্দা আবদুর রহিম জিহাদী জানান, ৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে এই দ্বীপে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ৯৪ ও ৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ও কিছু ঘরবাড়ি ধ্বংস হলেও বড় কোনো জলোচ্ছ্বাস বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। এসব ঘূর্ণিঝড়ে কিছু নারকেল ও কেয়াগাছ হেলে পড়লেও উপড়ে পড়েনি। ফলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধী হিসাবেই কেয়ার চাষ করা হয় সেন্টমার্টিনে।

গবেষকরা মনে করেন, সেন্টমার্টিনের মতোই কক্সবাজারের অন্যান্য সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায়ও কেয়া বন সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে এর জন্য সামান্য কষ্ট করে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কেয়া সাধারণত নুড়িপাথর মিশ্রিত বালুকাময় মাটিতে ভালো জন্মে। উখিয়ার ইনানী-পাটুয়ারটেক এলাকায় প্রায় একই ধরনের পরিবেশ রয়েছে।

কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক মনে করেন, উপকূলের রক্ষাকবচ হিসাবে সৈকতে ব্যাপকভাবে কেয়াবন তৈরির মাধ্যমে একদিকে উপকূল রক্ষা, অন্যদিকে এর ঔষধিগুণের ওপর ভিত্তি করে এদেশেও বড় মাপের ওষুধ শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে পারে।

পরিবেশ বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর রাগিবউদ্দিন আহমদ বলেন, সামুদ্রিক তীব্র হাওয়াসহ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কেয়া ও নারকেলগাছ উপড়ে পড়ে না বলে গাছ দুটিকে সমুদ্র উপকূলের শক্তিশালী ও সেরা প্রজাতি বলে বিবেচনা করা হয়।

সমুদ্র তীরের অগ্রবর্তী বালিয়াড়িতে সাগরলতা, এরপর কেয়া এবং তৃতীয় সারিতে নারকেলের বাগান করে একদিকে উপকূলে শক্তিশালী বেষ্ঠনী তৈরি করা যায়, অন্যদিকে এসব গাছের পুষ্টি ও ঔষধিগুণসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব কাজে লাগিয়ে দেশের ব্লু-ইকোনমিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার তৈরি করা যায়।

সারা বিশ্বে ৬শ থেকে ৭শ প্রজাতির কেয়াগাছ রয়েছে। তবে সেন্টমার্টিনে জন্মে প্যান্ডানাস টেকটরিয়াস প্রজাতির কেয়া।

এ প্রজাতির কেয়া মালয়েশিয়া থেকে ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে হাওয়াই পর্যন্ত জন্মায়। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা ও ভারতের বিভিন্ন উপকূলসহ বেশিরভাগ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত অঞ্চলে পাওয়া যায় কেয়া।

কেয়া গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এর মধ্যে প্যান্ডানাস টেকটরিয়াস লম্বায় ৩ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ গাছের কাণ্ড গোলাকার ও কাঁটাযুক্ত। কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়। গাছগুলো প্রায় বাঁকা হয়। গাছের নিচে থেকে মোটা শাখা পর্যন্ত বেশ কিছু মূল বের হয়ে মাটিতে ভিত্তি তৈরি করে। এগুলোকে ঠেসমূল বলা হয়। এই মূল গাছের কাণ্ডকে দৃঢ়ভাবে মাটির সঙ্গে যুক্ত করে এবং গাছের ভার বহনে সহায়তা করে। পাতা পাঁচ থেকে সাত ফুট লম্বা, দুই থেকে তিন ইঞ্চি চওড়া, পাতার কিনারা করাতের মতো খাঁজ কাটা হয়। দেখতে অনেকটা আনারসের পাতার মতো। আশ্বিন-কার্তিক মাসে কেয়াগাছে আনারসের মতো ফল হয়। লম্বায় সাত থেকে আট ইঞ্চি আকারের ফল দেখতে কমলা, পীত বা ধূসর রঙের মতো। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কেয়া ফুল দেয়। একে তাই বর্ষার ফুলই বলা হয়। ফুল সাদা ও সুগন্ধীযুক্ত। স্ত্রী পুষ্পগুলো পুংপুষ্পের তুলনায় আকারে ছোট হলেও সুগন্ধ বেশি। ফুলে মধু না থাকলেও ভ্রমর বসে।

প্রাচীনকাল থেকেই কেয়া ফুলের সুগন্ধ এবং ভেষজ গুণের কথা সুবিদিত হলেও মেধাস্বত্ব বা ঐতিহ্যগত জ্ঞান হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীন সাহিত্যেও লিপিবদ্ধ আছে কেয়ার কথা। বৌদ্ধ জাতকে কেয়ার কথা রয়েছে। জাতকের মাধ্যমে জানা যায়, আড়াই হাজার বছর আগে হিমালয়ে কেয়াগাছ ছিল। স্কন্দপুরাণে কেয়া ফুলের কথা আছে। দ্বাদশ শতাব্দীর কবি জয়দেব কেয়া ফুলের আকার-আকৃতি নিয়ে গান রচনা করেছেন।

আরও খবর