১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে চৈত্র মাস (১৪ এপ্রিল) পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৩ জানুয়ারি বিকাল তিনটায় বঙ্গবন্ধু এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা সচিবালয় ত্যাগ করার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব তৌফিক ইমাম সাংবাদিকদের বৈঠক বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান।
তৌফিক ইমাম বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৩৭৮ এর চৈত্র মাস অর্থাৎ ৭২ এর ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বকেয়া ও সুদসমেত কৃষিজমির সবরকম খাজনা মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্ত সরকারি হ্যান্ডআউটে জানানো হয়। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের বাঁচার সংগ্রাম, গ্রামাঞ্চলে বর্বরবাহিনীর ধ্বংসলীলা এবং লাখ লাখ লোকের গৃহহারা হওয়ার কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি এদিন সকাল সাড়ে ১১টায় অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় পতাকা থেকে দেশের মানচিত্র বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দেশের মানচিত্র সংবলিত পতাকা অত্যন্ত জটিল এবং সাধারণ লোকের পক্ষে এর সঠিক নমুনা তৈরি অসুবিধাজনক বিধায় এই পরিবর্তন আনা হয়। একইসঙ্গে সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন বাংলায় প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সুবিধার্থে গেজেটের একটি ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশ করা হবে। বাসসের বরাতে দৈনিক বাংলায় এ খবর প্রকাশ করা হয়।
জাতীয় সংগীত ও কুচকাওয়াজ সংগীত নির্ধারণ
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এইদিনের বৈঠকে। যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধারা এই গানটি গেয়ে উজ্জীবিত থাকতেন বলে সেটিকে বিবেচনায় রাখা হয়। গানটির শুরু হচ্ছে— আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আর শেষ হচ্ছে— মা তোর বদনখানি মলিন হলে ওমা আমি নয়ন জলে ভাসি। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক উৎসব অনুষ্ঠানে যন্ত্রের মাধ্যমে শুধু প্রথম চার লাইন বাজানো হবে। মন্ত্রিসভা একইসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘চল চল চল’ গানটির ২১টি লাইন কুচকাওয়াজ সংগীত হিসেবে নির্ধারণ করে।
দফতর পুনর্বণ্টন
দৈনিক বাংলা পত্রিকায় এইদিন লিড স্টোরি ছিল মন্ত্রিসভার বৈঠক এবং দফতর পুনর্বণ্টন নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজের হাতে দেশরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, কেবিনেট সংক্রান্ত দফতর, তথ্য ও বেতার দফতরের দায়িত্বভার রেখে অন্যান্য দফতর মন্ত্রীদের মাঝে পুনর্বণ্টন করে দেন। বলা হয়, যেসব দফতরের ভার কোনও মন্ত্রীকে দেওয়া হয়নি, সেসব দফতরও তার হাতে থাকবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প ও বাণিজ্য, তাজউদ্দিন আহমেদ অর্থ, পরিকল্পনা ও রাজস্ব দফতর, এম মনসুর আলীকে যোগাযোগ দফতর, খন্দকার মোশতাক আহমদ বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, এ এইচ এম কামরুজ্জামন সাহায্য ও পুনর্বাসন দফতর, শেখ আব্দুল আজিজ কৃষি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় দফতর, অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক দফতর, জহুর আহমদ চৌধুরীকে স্বাস্থ্য, শ্রম সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা দফতর, ফণীভূষণ মজুমদারকে খাদ্য ও সরবরাহ বিভাগ, ড. কামাল হোসেনকে আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ক দফতর ও শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সংক্রান্ত দফতরের দায়িত্ব ভার দেওয়া হয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী ও বর্বর সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ১৬ জানুয়ারি শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সেদিন সরকারি-বেসরকারি ভবনে পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং সবাই কালো ব্যাজ ও কালো বাহুবন্ধনী ব্যবহার করবে। এছাড়া, সব উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়।
ঘর ও বাইর গোছানোর কাজ শুরু
সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনে একইসঙ্গে দলগুছানোর কাজে হাত দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দেশ গঠনে কঠোর পরিশ্রম করতে দলীয় কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। বাসসের খবরে বলা হয়, ১৩ তারিখ আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এই আহ্বান জানান।
এদিকে, দেশ-বিদেশ থেকে অভিনন্দন বাণীর মধ্যে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর অভিনন্দনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুকে ইন্দিরা গান্ধী তার অভিনন্দন বাণীতে জানান, ‘জাতিসমূহের মধ্যে শান্তি ও মৈত্রীর স্বার্থে বাংলাদেশ-ভারত একযোগে কাজ চলবে। আপনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করায় আমাদের সমগ্র জাতি, আমার সহকর্মীরা ও আমি আনন্দবোধ করছি। এই ঐতিহাসিক ঘটনা উপলক্ষে আমি আপনাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আপনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা, সহনশীলতা ও মানবিক মর্যাদার অভিভাবক হিসেবে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে।’
মুজিব বাহিনির সদস্যদের প্রতি নির্দেশ
৭ জানুয়ারি বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত নির্দেশনাবলী মেনে চলার জন্য মুজিব বাহিনিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) মুজিব বাহিনির বিবৃতিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয় বলে বাসস সংবাদ প্রকাশ করে। বলা হয়, কোনও কোনও মহল দুরভিসন্ধিমূলকভাবে ইতিপূর্বে প্রদত্ত নির্দেশনাবলী অপব্যাখ্যার চেষ্টা করেছে। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলছি, মুজিব বাহিনিই এ নির্দেশনাবলী দিয়েছিল। ওই নির্দেশের ভিত্তিতে মুজিববাহিনির সদস্যরা সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ছাড়া মুজিব বাহিনির কোনও সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করবেন না। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকের মতো কাপুরুষোচিত হামলার ব্যাপারে ধুম্রজাল সৃষ্টির উদ্দেশে রমনায় যে প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয় খান আলোচনা করেছিল, সেই ভবনটিকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে রূপান্তরিত করা হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-