দীর্ঘ ৯ মাস কারাবন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন। পাকিস্তান প্রথমে তাকে লন্ডনে পাঠায়। সেখান থেকে একদিন পর দিল্লি হয়ে দেশে ফেরেন তিনি। সেদিন বিমানে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছিলেন ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। লন্ডন প্রবাসী শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির সঙ্গে টেলিফোনে বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি ২০২০) বাংলা ট্রিবিউনের কথা হয়। তিনি সেদিনের অভিজ্ঞতা, সারাপথে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো ১৩ ঘণ্টায় কী কী ঘটেছিল, স্মরণ করতে গিয়ে বারবারই বলতে থাকেন— ‘পুরো পথ এই নেতা তার দেশ, দেশের মানুষ ছাড়া কিছুই ভাবেননি। একজন নেতা তার দেশকে এতটা ভালবাসতে পারে আমার ধারণার বাইরে ছিল।’
সেই দিন সেই ব্রিটিশ বিমানে ১১ জন ক্রু, দুই জন পাইলট, একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, তিন জন গ্রাউন্ড ক্রু, একজন লেডিসহ দুই জন স্টুয়ার্ট এবং দুই জন সিকিউরিটি কর্মকর্তা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পাইলট কুকসহ সব ক্রুদের তাঁর ভ্রমণ আনন্দদায়ক করার জন্য ধন্যবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু কিছুটা ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু তার ভাবনায় কোনও ক্লান্তি ছিল না। তিনি দেশে ফেরার জন্য ভীষণ অধীর হয়ে ছিলেন। ১১ জানুয়ারি সকালে কমিট বিমানটি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে।
সেদিনের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা প্রশ্নে শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি বলেন, ‘আমি ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসে কাজ করেছি। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। আমি থাকি ইত্তেফাক অফিসের লাগোয়া চক্রবর্তী ভিলায়। ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে খবর এলো ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া দেখা করতে বলেছেন। গিয়ে দেখা হলো শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। লুঙ্গি আর চটি পরা। সেদিন প্রথম তিনি ভারতের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সহায়তা চেয়েছিলেন।’
এরপর লন্ডন থেকে ফেরার পথে দেখা হলো?
শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি: শুধু দেখা না, কী ভীষণ সময় কাটালাম আমরা। অত কথা বলে শেষ করা যায় না। বাংলাদেশের পর তাঁর সঙ্গে লন্ডনে দেখা হলো। তিনি পুরোটা সময়ই কী কী করবেন সেগুলো ভাবছিলেন, আর আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন। হঠাৎই তিনি আমার কাছে একটা সহযোগিতা চেয়ে বসলেন। আমি বললাম, আমার সাধ্যে থাকলে অবশ্যই করবো। তিনি আমাকে বরাবরই ব্যানার্জি বলে ডাকতেন। বললেন, ‘ব্যানার্জি, দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তাঁর কানে একটি খবর পৌঁছাতে হবে। আমি চাই ছয় মাস না, তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ভারতে ফেরত নিতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে।’ আমি সেই কাজটি দিল্লিতে নেমে করে দেই। মিসেস গান্ধী আমাকে সেই সময় বলেন, ‘আমি তাঁর মুখ থেকে সেটি শুনতে চাই।’ পরবর্তীতে তারা পরস্পর বিষয়টি আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন ।
বঙ্গবন্ধু দেশ নিয়ে আর কী ভাবছিলেন?
শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি: উনার যেন শারীরিক সমস্যা না হয় সেকারণে সরাসরি বিমান আসেনি। মাঝে সাইপ্রাসে নামে, ওমান নামে এবং দিল্লিতে যায়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবারও উড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন,‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায়ভালোবাসি’। দুইবার গাইলেন। প্রথমবার দেখি তাঁর চোখ ভরে উঠেছে জলে। আমি বললাম, আপনি কাঁদছেন। তিনি বলছেন, ‘ধরে ফেলেছো। আসুন, আবারও গাই।’ হঠাৎ তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। বললেন ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?’ আমি বলেছিলাম, আপনি নেতা, আপনি যা ঠিক করবেন। তবে আপনি একটা ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন। এই উপমহাদেশের তিনটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনও না কোনোভাবে জড়িয়ে গেলেন। তখন আনন্দে উত্তেজনায় তার ভেতরকার অস্থিরতা আমার মধ্যে সঞ্চারিত হলো।
আরেকটি বিষয় তিনি কিন্তু আমাদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন— বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা কেমন হবে, প্রধানমন্ত্রী সেখানে সব ক্ষমতার উৎস বিবেচিত হবেন। তিনি সংসদ কার্যকর করবেন কীভাবে সবকিছু নিয়েই ভাবছিলেন আর আলাপ করছিলেন।
এরপর কি আর কখনও যোগাযোগ হয়েছিল?
শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার আর একবারই দেখা হয়েছিল। তিনি ১৯৭৩ সালে একবার লন্ডনে এলেন, তখন। এরপর তার কন্যার সরকার আমাকে কয়েকবার স্মরণ করেছে। আমার বয়স ৮৬ বছর। এখন আমার আর কোথাও যাওয়া সম্ভব না। আবার কেউ কেউ আমাকে সেখানে না যেতেও বলেছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নানা ভয়ভীতি দিয়েছেন। সেসব আমি শুনে উড়িয়ে দিয়েছি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-