বিশাল রোহিঙ্গার ভারে তছনছ উখিয়া-টেকনাফ

রফিকুল ইসলাম ◑
দুই দুইবার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের আনুষ্ঠানিক উদ্যেগ ভেস্তে যায়। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত পাঠানোর তেমন কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বিপুলসংখ্যক বিদেশী উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় প্রদানের কারণে বাংলাদেশ তো বটে বিশেষত স্হানীয় জনগোষ্ঠী পড়েছে মহাবিপাকে।

রোহিঙ্গা ঢলের আশ্রয়ের বিগত এ সময়ে দেশী বিদেশী অনেক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব সহ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরির্দশনে এসেছেন অনেক নামী দামী সেলিব্রেটি। এসেছেন জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনেক কর্তাব্যক্তি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত – আইসিসি ও আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত – আইসিজে প্রসিকিউটর বেনসোদা সহ আইনজ্ঞ, কৌশলী, আমেরিকান যুদ্ধাপরাধ আলামত সংগ্রহ টিম,আসিয়ান জোট প্রতিনিধিরা সহ অনেক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিশেষগণের আগমন ঘটে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা মেগা ক্যাম্পে।

২০১৯ সালের সকল দুঃখ-বেদনা ভুলে মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে নতুন আশা নিয়ে বরণ করছে ২০২০ সালকে। রাত ১২ টার পর ইংরেজি নববর্ষ ২০২০ সালকে স্বাগত জানায় পুরো দেশ। আর বিদায়ী বছর ২০১৯ এ নানান ইস্যুতে আলোচিত ছিল দেশের উপকূলীয় পর্যটন জেলা কক্সবাজার।
এ বছর সবচেয়ে আলোচনায় ছিল রোহিঙ্গা ও ইয়াবা নির্মূল ইস্যু।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৭ লাখের বেশী রোহিঙ্গা। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে কক্সাবজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লক্ষাধিক। এসব রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক চাপে ফেলে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে গঠন করা হয় যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি।

যে কমিটি রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে কাজ করছে। কিন্তু ২০১৮ সালের নভেম্বর ও ২০১৯ সালের জুনে দ্বিতীয় দফা চেষ্টার পরও রোহিঙ্গাদের অসম্মতিতে প্রত্যাশিত সেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সচল করা সম্ভব হয় নি। যা দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের  আলোচিত বিষয়। আলোচনায় আসে স্থানীয়দের ওপর চাপ কমাতে অন্তত ১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে উখিয়া ও টেকনাফ থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা। কিন্তু বিভিন্নভাবে ভিন্নমত আসায় তাও কার্যকর হচ্ছে না।

রোহিঙ্গাদের কারণে ৪০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে দিনমজুরের দৈনিক মজুরি ৫০ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর অন্তত ৬০০ জেলে পরিবার নাফ নদীতে মাছ ধরতে পারছে না। বন জঙ্গল উজাড় করে রোহিঙ্গাদের আবাসন ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোর অবনতির ফলে ২০ শতাংশ যোগাযোগ ব্যয় বেড়েছে। আবাসন ব্যয় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ১০০ হেক্টর আবাদি জমি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শিক্ষার হার কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। যেখানে প্রাথমিকে ৩৯.৪% ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪৬.৫%। সম্প্রতি কক্সবাজারে এক সভায় এ তথ্য জানানো হয়।

বন বিভাগের তথ্য মতে,উখিয়া ও টেকনাফের ৬১৬৪ একর বনভূমি ধংস করে গড়ে তোলা হয়েছে ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। উখিয়ায় ২৬ ও টেকনাফে ৮ টি ক্যাম্প স্হাপনের কারণে ২০২৮ একর সৃজিত বনায়ন ও ৪১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করা হয়েছে। কঠিন বিপদসংকুল অবস্হায় টিকে থাকা এশিয়ান হাতির অন্যতম বাসস্থান,বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র ছিল মূলত এ বনাঞ্চল।

২০১৭ সালের পূর্বের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের এসব এলাকায় ৬৩ টি হাতি ছিল। অবশ্য বর্তমানে হাতির সংখ্যা কত তা স্পষ্ট নয়। এসব হাতির প্রধান করিডোর বালুখালী – ঘুনধুম রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্হাপনের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ৪.৩৫ বর্গ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১.১৩ কিলোমিটার প্রস্হের এ করিডোরটি সম্পূর্ণ বন্ধ হযে পড়ায় এ অঞ্চলের হাতি গুলো চরম বিপদাপন্ন বলে জানা গেছে।

কিছু কিছু রোহিঙ্গাদের এলপি গ্যাস প্রদান করা হলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা প্রাকৃতিক ও সৃজিত  বনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্হাপনা খাতে ৬১৬৪ একরের বাইরে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও  ১৮৩৭ একর বনজ সম্পদ। এক্ষেত্রে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৪২১ কোটি টাকা বলে জানা গেছে।

গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর উপলক্ষে মহা সমাবেশের ডাক দেন রোহিঙ্গা কথিত সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস নেতা মুহিব উল্লাহ। ঐ মহা সমাবেশে লাখো  রোহিঙ্গার সমাগম ঘটে, যা দেশবাসী, প্রশাসন, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী সংশ্লিষ্টদের রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলে। কথিত মহা সমাবেশের মধ্য দিয়ে বাস্তুহারা আশ্রিত রোহিঙ্গারা আশ্রয়দাতা বাংলাদেশের প্রতি হুমকির কারণ হয়ে অভিভূত হয়।

এছাড়াও এ বছরের (২০১৯) ৪ ফেব্রুয়ারী রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আসেন হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।  অ্যাঞ্জেলিনা জোলি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনএইচসিআর’-এর বিশেষ দূত হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসেছেন।  এছাড়াও আলোচনায় ছিল মার্কিন, চীন, প্রতিনিধি ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান সহ উচ্চ পর্যায়ের ভিভিআইপি গণরোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর।

চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি হয়েছে দেশের ইয়াবা রাজ্য খ্যাত টেকনাফের ইয়াবার গডফাদারদের আত্মসমর্পণ। যা পুরো দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এসময় প্রায় ১০২ ইয়াবা গডফাদার আত্মসমর্পণ করে। এছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রায় তিন শতাধিক ইয়াবা কারবারি, ডাকাত ও সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে এ বছরেই। যা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২৩ নভেম্বর মহেশখালী-কুতুবদিয়ার ৯৫ জলদস্যু ও অস্ত্র কারীগরদের আত্মসমর্পণও বেশ আলোচনায় আসে।

এছাড়াও আলোচিত ছিল টেকনাফের হ্নীলা ইউপির জাদিমোরার যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যা ও উখিয়ার একই পরিবারের চারজনকে গলাকেটে হত্যা ছিল বেশ আলোচিত ঘটনা। সর্বশেষ উখিয়ার পূর্বরত্না বড়ুয়া পাড়ায় গত ২৯ ডিসেম্বর দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে জন্মদাতা পিতার ছুরিকাঘাতে নিহত হন ছেলে  রাকসেন বড়ুয়া। বছরের শেষ প্রান্তে এসে ৩০ ডিসেম্বর বিকেলে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা গুলি করে দুই জন র‌্যাব সদস্যকে গুরুতর আহত করে।

২৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে উখিয়া উপজেলার পূর্ব রত্না এলাকার তালাবদ্ধ বাড়ি থেকে একই পরিবারের চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলেন, ওই এলাকার মৃত প্রবীণ বড়ুয়ার কুয়েত প্রবাসী ছেলে রোকেন বড়ুয়ার মা সখি বড়ুয়া, তার স্ত্রী মিলা বড়ুয়া, একমাত্র ৫ বছরের শিশু সন্তান ও আপন ভাতিজি।

২২ আগস্ট টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি ও জাদিমোরা এলাকার মোনাফ কোম্পানীর ছেলে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ১ সেপ্টেম্বর ভোরে  টেকনাফে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যা মামলার প্রধান আসামি রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদ পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। এ সময় পুলিশ বেশ কিছু অস্ত্র ও কার্তুজ উদ্ধার করে। এদিকে তার কাছে বাংলাদেশের পরিচয় পত্র (এনআইডি) পাওয়া গেছে। যা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল আলোচনা-সমালোচনার।

এছাড়াও ২২ বছর পর সেন্টমার্টিনে বিজিবির বিওপি স্থাপন করেছে বিজিবি। চলতি বছরের ৭ এপ্রিল সেন্টমার্টিনজুড়ে বিজিবি মোতায়েন করে সরকার। মূলত সেন্টমার্টিনকে মিয়ানমার উদ্ভট ভাবে তাদের দাবি করার পর পরই বিজিবি মোতায়েন করে।

১৯৯৭ সালে তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) তুলে নেয়া হয়। প্রায় ২২ বছর পর আবারো সেন্টমার্টিনে বিজিবি মোতায়েন করাকে অনেকে আলোচনায় নিয়ে আসে।

আরও খবর