ডেস্ক রিপোর্ট ◑ মামলা বাড়লেও, কমেনি ইয়াবা পাচার হ গত পাঁচ বছরে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে দশগুণ। মূল পাচারকারী ধরা ছোঁয়ার বাইরে হ পুলিশ,কোস্টগার্ড, সেনা ও আনসার ভিডিপি সদস্যরা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে হ ‘বহনকারীরা অধিকাংশ সময় মূল পাচারকারীর নাম বলে না। নাম না বললে আসামি করা সম্ভব হয় না’
প্রতিদিন নগরীর কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইয়াবা উদ্ধার করলেও কমেনি ইয়াবা পাচার। নগরীর ষোল থানায় প্রতিদিন গড়ে পনেরোটির অধিক মাদক সংক্রান্ত মামলা রেকর্ড হচ্ছে। এরমধ্যে ইয়াবা উদ্ধার সংক্রান্ত মামলা সবচেয়ে বেশি। মামলার পরিসংখ্যান বাড়লেও কমেনি ইয়াবার ব্যবহার। গত পাঁচ বছরে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে দশগুণ। মাঝে মাঝে গুটিকয়েক ইয়াবা বহনকারী ধরা পড়লেও মূল পাচারকারী বরাবরই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অধিকাংশ মামলায় তদন্তে ইয়াবা পাচারের রুটের বিষয়টি উঠে আসে না। ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ, কোস্টগার্ড, সেনাসদস্য এমনকি আনসার ভিডিপি’র সদস্য। নগর পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা কয়েক বছরের ব্যবধানে হয়েছেন কোটিপতি। অনেকে ইয়াবা বেচাকেনার সাথে জড়িত।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের বন্দর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) এস এম মোস্তাইন হোসাইন বলেন, সবসময় বহনকারী ধরা পড়ে তাও কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে পাচারকারীও ধরা পড়ে। মূল পাচারকারী ধরা না পড়া প্রসঙ্গে ডিসি মোস্তাইন জানান, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মাদকদ্রব্য আইনের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করতে হয়। তবে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে দীর্ঘদিন তদন্তও করা যায়। মামলার সংখ্যা বেশি হওয়াতে অনেক সময় দীর্ঘদিন তদন্ত করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাছাড়া শুধু পুলিশ একার পক্ষে ইয়াবা পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে পুরোপুরি ইয়াবা নির্মূল সম্ভব নয়।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মেট্টো অঞ্চলের উপ- পরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, ইয়াবা বহনকারীরা অধিকাংশ সময় মূল পাচারকারীর নাম বলে না। আর নাম না বললে মামলায় আসামি করা সম্ভব হয় না। বহনকারী ধরা পড়লেও তাকে জামিনের ব্যবস্থা, কারাগারে থাকাকালিন সময় তার পরিবারের খরচ বহন সবকিছুই পাচাকারীরা করে থাকে। যার কারণে পাচারকারিদের সঠিক পরিচয় অধিকাংশ সময় পাওয়া যায়না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শামীম বলেন, ২০১৮ সালের মে মাস থেকে ইয়াবার বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে পাচারকারীরা রুট পরিবর্তন করে। টেকনাফ থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি,সিলেট, ময়মনসিংহ, জামালপুর, চাপাই নবাবগঞ্জ এমনকি ভারতের মনিপুর সীমান্ত দিয়েও সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবা পাচার হচ্ছে। ইয়াবার প্রবাহ কমলেও বহনকারী কমেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘যে পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয় তা মামলায় দেখানো হয় না। নিজেদের কাছে রেখে দেওয়া ইয়াবা আবার বাজারে চলে যাচ্ছে। যে সোর্স ইয়াবা ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে তাকে শতকরা ৩০ শতাংশ দিয়ে দিতে হয়। এতে মাদকের মামলা বাড়লেও কার্যত কোন লাভ নেই’।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নগরীর ষোল থানায় মাদক উদ্ধার সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৩ হাজার ৯’শ ৩৫টি। এরমধ্যে ২০১৩ সালে পুরো বছরে হালিশহর থানায় মাদক আইনে মামলা হয়েছিলো ৯৪টি। পরের বছরগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে মাদক সংক্রান্ত মামলার পরিসংখ্যান। ২০১৪ সালে ১২৭, ২০১৫ সালে ১১৫, ২০১৬ সালে ১৭৯ এবং ২০১৭ সালে ২৩৬ টিসহ পাঁচ বছরে হালিশহর থানায় দায়েরকৃত ৭৫১টি মামলার মধ্যে ৯৫ শতাংশ মামলাই ইয়াবা উদ্ধার সংক্রান্ত। অন্য মামলাগুলোর মধ্যে ফেন্সিডিল কিংবা গাঁজা উদ্ধার রয়েছে।
কর্ণফুলী থানায় ২০১৩ সালে পুরো বছরজুড়ে ১৯টি মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছিলো। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে ৯৭টি, ২০১৫ সালে ৫১টি, ২০১৬ সালে ২৬৮টি, ২০১৭ সালে ৩৬৬টিসহ মোট ৮৪৩টি, খুলশী থানায় ২০১৩ সালে ১০৮টি, ২০১৪ সালে ১১২টি, ২০১৫ সালে ১২১টি, ২০১৬ সালে ১২১টি, ২০১৭ সালে ১৫৭টিসহ ৬১৯টি, পাহাড়তলি থানায় ২০১৩ সালে ১০১টি, ২০১৪ সালে ১২৯টি, ২০১৫ সালে ১২২টি, ২০১৬ সালে ১৪২টি, ২০১৭ সালে ১৫৪টিসহ পাঁচ বছরে ৬৪৮টি মামলা হয়েছে।
চান্দগাঁও থানায় পাঁচ বছরে মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১১’শ ৪টি। এরমধ্যে ২০১৩ সালে ১৩১টি, ২০১৪ সালে ১৪৫টি, ২০১৫ সালে ২২৮টি, ২০১৬ সালে ১৭৯টি ও ২০১৭ সালে ২৩৬টি, আকবরশাহ থানায় ২০১৩ সালে ৩০টি, ২০১৪ সালে ১৮৫টি, ২০১৫ সালে ১৫৯টি, ২০১৬ সালে ৩১৯টি, ২০১৭ সালে ৩৭০টিসহ পাঁচ বছরে ১০৬৩টি। ইপিজেড থানায় ২০১৩ সালে ৩৬টি, ২০১৪ সালে ৭২টি, ২০১৫ সালে ৭৯টি, ২০১৬ সালে ১৮৮টি, ২০১৭ সালে ২৬৯টিসহ ৬৪৪টি মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে।
এ পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি মাদক সংক্রান্ত মামলা রেকর্ড হয়েছে নগরীর কোতোয়ালী থানায়। পাঁচ বছরে মামলার সংখ্যা এক হাজার একশো ১৯টি। এরমধ্যে ২০১৩ সালে ২৮৭, ২০১৪ সালে ৩৭০টি, ২০১৫ সালে ২৩৮টি, ২০১৬ সালে ৪৯৬টি ও ২০১৭ সালে ৬০৮টি মাদকের মামলা রেকর্ড হয়েছে। তবে গত দুই বছরে (২০১৮-২০১৯) কোতোয়ালী থানায় মামলার সংখ্যা তুলনামূলক কমেছে।
বাকলিয়া থানায় পাঁচ বছরে মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৫২৬টি। এরমধ্যে ২০১৩ সালে ১৮৮টি, ২০১৪ সালে ৩৭৫টি, ২০১৫ সালে ২৮১টি, ২০১৬ সালে ৩২৩টি, ২০১৭ সালে ৩৫৯টি মামলা হয়েছে।
বায়েজিদ থানায় পাঁচ বছরে মামলা হয়েছে ১২’শ ১৯টি। এরমধ্যে ২০১৩ সালে ২০৯টি, ২০১৪ সালে ১৮৭টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ৩৩৪টি ও ২০১৭ সালে ৩৩৭টি মামলা রেকর্ড হয়েছে।
সবচেয়ে কম মাদক সংক্রান্ত মামলা রেকর্ড হয়েছে চকবাজার থানায়। পাঁচ বছরে দায়ের করা ৩১৯ টি মামলার মধ্যে ২০১৩ সালে ১৯টি, ২০১৪ সালে ৭১টি, ২০১৫ সালে ৩৫টি, ২০১৬ সালে ৮৩টি, ২০১৭ সালে ৮৭টি, বন্দর থানায় ২০১৩ সালে ১৯টি, ২০১৪ সালে ১৯৩টি, ২০১৫ সালে ৬৫টি, ২০১৬ সালে ১২৭টি, ২০১৭ সালে ১৯৮টিসহ মোট ৬০২টি, সদরঘাট থানায় ২০১৩ সালে ১৩৬টি, ২০১৪ সালে ১৬৭টি, ২০১৫ সালে ১০৬টি, ২০১৬ সালে ২০৫টি, ২০১৭ সালে ২০১টিসহ ৮১৫টি মাদক সংক্রান্ত মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
পাঁচ বছরে পাঁচলাইশ থানায় মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৪৬৮টি। এরমধ্যে ২০১৩ সালে ৩৮টি, ২০১৪ সালে ৮৭টি, ২০১৫ সালে ১১৬টি, ২০১৬ সালে ১১১টি, ২০১৭ সালে ১১৬টি।
পতেঙ্গা থানায় পাঁচ বছরে মাদক উদ্ধারের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে ৫৩৮টি। এরমধ্যে ২০১৩ সালে ৭৯টি, ২০১৪ সালে ৫৩টি, ২০১৫ সালে ৭৪টি, ২০১৬ সালে ১৩২টি, ২০১৭ সালে ২০০টি এবং ডবলমুরিং থানায় ২০১৩ সালে ১৪৬টি, ২০১৪ সালে ১৪২টি, ২০১৫ সালে ১২৮টি, ২০১৬ সালে ১৩৮টি, ২০১৭ সালে ২২৩টিসহ পাঁচ বছরে মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৭৭টি।
তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালে নগরীর ১৬ থানায় মাদক উদ্ধার সংক্রান্ত মামলা রেকর্ড হয়েছিলো ১৭০৬টি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৭ সালে ১৬ থানায় মাদক সংক্রান্ত মামরা রেকর্ড হয়েছে ৪১৯১টি। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইয়াবা পাচার সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বাড়লেও গত দুই বছরের তুলনামূলক মামলার সংখ্যা কমেছে কিন্তু কমেনি ইয়াবা পাচার।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-