পথে পথে ভয়ংকর মাইন পুঁতেছে মিয়ানমার

সারোয়ার সুমন ◑

হাতির চলার পথে ভয়ংকর মাইন পুঁতেছে মিয়ানমার। রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা ১৯৩ কিলোমিটার সীমান্তে এ মাইন পুঁতেছে তারা। এরই মধ্যে মাইন বিস্টেম্ফারণে মারা গেছে বেশ কয়েকটি হাতি। চুনতি অভয়ারণ্যে থাকা হাতির দল তাই মিয়ানমার সীমান্তে না গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে নতুন করিডোর খুঁজছে বাংলাদেশে। গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারার মহাদেবপুর হয়ে বরুমছড়ার পাশ দিয়ে বাঁশখালীতে নতুন করিডোরে হাঁটছে চুনতির কিছু হাতি। আরেকটি অংশ পুরানগর-দোহাজারীর লালুতিয়া-গড়দুয়ারা হয়ে আসছে বোয়ালখালীর পাহাড়ে। বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে থাকা অর্ধশত হাতি এতদিন চলাফেরা করছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের ১২টি করিডোর দিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে এসব হাতি যেত মিয়ানমারে। আবার বনের পথ ধরে ফিরে আসত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার কিংবা রাঙামাটিতে।

হাতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এএইচএম রায়হান সরকার। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের হাতিগুলোর দীর্ঘদিনের অভ্যাস হচ্ছে তারা ঘুরেফিরে থাকে। বছরের নির্দিষ্ট সময় তারা মিয়ানমারে যায়, সেখানে থাকে। আবার কক্সবাজারের টেকনাফে কিংবা লোহাগাড়ার চুনতিতে ফিরে আসে। সেখান থেকে আবার পার্বত্য অঞ্চলে যায়। একটি হাতি একবার হাঁটা শুরু করলে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। এটা তাদের অভ্যাস। মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখায় এখন আর সেদিকে যেতে পারছে না হাতির দল। বাধ্য হয়ে হাতির দল তাই নতুন করিডোর খুঁজছে। এরই অংশ হিসেবে আনোয়ারায় নতুন করিডোরের সন্ধান মিলেছে। বোয়ালখালীর দিকে আরেকটি বিকল্প পথ তৈরি করতে চাচ্ছে চুনতি অভয়ারণ্যের হাতিগুলো।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৮ হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। আবার রেললাইনের জন্য পথ দিতে হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল দিয়ে। এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাতির জীবনচক্র। এজন্য অনেক সময় এরা লোকালয়ে নেমে আসছে। নষ্ট করছে ফসল। হাতির আক্রমণে মরছে মানুষও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিবির শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, মিয়ানমার তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। বনের মাঝেও পুঁতেছে মাইন। এর ফলে গত দুই বছরে অনেক মানুষ মাইন বিস্ম্ফোরণে আহত কিংবা নিহত হয়েছে। মারা গেছে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের বেশ কয়েকটি হাতিও। সাত হাজার ৭৬৪ হেক্টরের চুনতি বনাঞ্চল চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে। অবস্থান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে। বনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বিপন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য ১৯৮৬ সালে এই অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বন্য এশীয় হাতির যাতায়াতের করিডোর আছে এই অভয়ারণ্যে। এই বনে ১২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়। যার মধ্যে ৪৫ প্রজাতির উঁচু গাছও রয়েছে। এখানে ১৭৮ প্রজাতির জীবজন্তু ও ১৩৭ প্রজাতির পাখি পাওয়া যেত। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে ক্রমেই কমছে বন্যপ্রাণী। সংরক্ষিত এ বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত করে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাস নির্মাণ করা হয়েছে। স্থাপন করা হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনও।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত আছে কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায়। চুনতি অভয়ারণ্যের হাতি বাংলাদেশের এ তিনটি জেলার পাশাপাশি চলাচল করে মিয়ানমারেও। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে আছে হাতির তিনটি করিডোর। এগুলো হচ্ছে উখিয়া-ঘুমধুম, তুলাবাগান-পাথেরছড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারকুল। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে হাতি ব্যবহার করে পাঁচটি করিডোর। এগুলো হচ্ছে গমারিয়াঘোনা-রাজঘাট, তুলাতুলি-বিটঘর, ঘণ্টাখালি-মেগা কচ্ছপিয়া, খাসিয়াখালী-চাইরাখালী, খাসিয়াখালী-মানিকপুর। চুনতি অভয়ারণ্যের চট্টগ্রাম অঞ্চলে আছে হাতির চারটি করিডোর। এগুলো হচ্ছে চুনতি-সাতঘর, লালুতিয়া-গড়দুয়ারা, সুখবিলাস-কোদালা, নারিচ্ছা-কোদালা।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের লামা-আলীকদম সড়ক ঘেঁষেই রয়েছে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন ফাঁসিয়াখালী ফরেস্ট অফিস। এর আনুমানিক আট কিলোমিটারের ব্যবধানে সাফারি পার্কের কিছু আগে পড়েছে মেধাকচ্ছপিয়া ফরেস্ট অফিস। আর চুনতি অভয়ারণ্যের একটি অংশে আছে বাঁশখালী, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলা।

মাইন বিস্টেম্ফারণে মরছে মানুষ :বান্দরবানে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, ঘুমধুম ও আশারতলী সীমান্তে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মাইন পুঁতে রাখে বলে নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশও। সীমান্তে মিয়ানমারের মাইন পোঁতার প্রতিবাদও জানিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে হঠাৎ করে তারা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি মাইন পোঁতা শুরু করে বলে খবর প্রকাশ হয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সে। গত দুই বছরে সীমান্তে মাইন বিস্টেম্ফারণে আহত ও নিহত হয়েছে দুই ডজনেরও বেশি মানুষ। গত ২৯ নভেম্বর ঘুমধুম সীমান্তে মাইন বিস্টেম্ফারণে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়। এ সময় গুরুতর আহত হয় আরও দু’জন। নিহত যুবকের নাম হামিদ হোসেন। এর আগে ২৩ সেপ্টেম্বর ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি সীমান্তে মাইন বিস্টেম্ফারণে আব্দুল মজিদ নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হয়। এর ২০ দিন আগে ঘুমধুম সীমান্তের থুয়াইংগা ঝিরি এলাকায় মাইন বিস্টেম্ফারণে আরও এক যুবক নিহত হয়। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সীমান্ত পার হওয়ার সময় বিস্টেম্ফারণে দুই ব্যক্তির পা উড়ে যায়। পরে তাদের বাংলাদেশে এনে চিকিৎসা দেয় বিজিবি।

ভয়ংকর মাইনে মরছে হাতিও :শুধু মানুষ নয়; মাইন বিস্টেম্ফারণে মারা যাচ্ছে হাতিও। গত ৫ নভেম্বর লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা এলাকার একটি মৎস্য প্রকল্পে পানিতে ভাসমান অবস্থায় হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। হাতিটি মাইন বিস্টেম্ফারণে গুরুতর আহত হয়েছিল। এর ১১ দিন পর ১৬ নভেম্বর ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী এলাকার দুর্গম পাহাড়ি চাককাটার ঝিরিতে গুরুতর আহত আরেকটি হাতির মৃতদেহ পাওয়া যায়। ৩০ নভেম্বর কুমারী এলাকার দুর্গম পাহাড়ের ইসকাটার ঝিরির হরি রঞ্জনের রাবার বাগানের পাশে অন্য আরেকটি হাতির মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগে লামা উপজেলার রহমত উল্যাহর রাবার বাগান থেকে একটি, গজালিয়া ইউনিয়নের হাইমারা ঝিরি থেকে একটি এবং ইয়াংছা এলাকার সেলিমুল হক চৌধুরীর বাগান থেকে গুরুতর আহত একটি হাতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের চাকঢালা, আষাঢ়তলী সীমান্তের ৪৮ নম্বর পিলারের কাছে নোম্যান্স ল্যান্ডে মিয়ানমারের পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ম্ফোরণে একটি বন্যহাতির মৃত্যু হয় মাস কয়েক আগে।

হাতি চলাচলের ২১ পয়েন্টে হচ্ছে রেললাইন :দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত করছে হাতির চলার পথ। চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ফ্যাঁইস্যাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ভেতর দিয়ে প্রায় ২৭ কিলোমিটার রেললাইন বসানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতি গবেষক ফরেস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ এইচ এম রায়হান সরকার জানান, হাতির চলাচলের পথ শনাক্ত করার জন্য তিনটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসন্ত ও শরৎকালে দুটি সার্ভে পরিচালনা করা হয়। গবেষণায় তিনটি বনাঞ্চলে ২১টি স্থানে হাতির আবাসস্থল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৩টি স্থান চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, সাতটি ফ্যাঁইস্যাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে এবং একটি মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কে। চুনতিতে ১১টি, ফ্যাঁইস্যাখালীতে সাতটি এবং মেধাকচ্ছপিয়াতে দুটি ক্যামেরা বসানো হয়। প্রায় সাত মাস ধরে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এসব ক্যামেরা। তিনটি সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাতি চলাচল করে ফ্যাঁইস্যাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে।

বাঁচার জন্য নতুন করিডোর খুঁজছে হাতির দল :সীমান্তে মিয়ানমার মাইন পুঁতে রাখায় বাঁচার জন্য নতুন পথ খুঁজছে অভয়ারণ্যের হাতিরা। চলাচলের জন্য নতুন করিডোর খুঁজছে তারা। হাতির নতুন করিডোরটি হলো আনোয়ারার মহাদেবপুর হয়ে ৬ নম্বর রাবখাইন ইউনিয়নের জিবাসী স্কুলের পাশ দিয়ে ফাজিল খাঁর হাট হয়ে খাটখালী খাল অতিক্রম। এরপর ৫ নম্বর বরুমছড়া আনসার চেয়ারম্যানের মৎস্য প্রকল্পের পাশ দিয়ে তৈলার দ্বীপ শঙ্খ নদী পার হয়ে বাঁশখালীর পাহাড়। সম্প্রতি বন্যপ্রাণী প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ ও একদল গবেষক এ করিডোরটি শনাক্ত করেন। আরেকটি নতুন করিডোর পুরানগর-দোহাজারীর লালুতিয়া-গড়দুয়ারা হয়ে বোয়ালখালীর পাহাড়ে এসেছে বলে ধারণা করছেন হাতি গবেষক রায়হান সরকার। তিনি জানান, মিয়ানমারে প্রবেশ করতে না পেরেই হাতিগুলো বিকল্প করিডোরে আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়বে। তখন বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও।

আরও খবর