বিবিসি ◑
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ইস্যুতে যখনই ভারত সরকারের সমালোচনার চেষ্টা হয়েছে, তখনই প্রতিবাদকারীরা ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রতিবন্ধকতা কিংবা হামলার মুখে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভারত সরকারের যে কোন পদক্ষেপের বিরোধিতা করা বাংলাদেশে বেশ ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় হয়ে উঠেছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ডাকসুর ভাইস-প্রেসিডেন্ট বা ভিপি নুরুল হক নূরের ওপর সর্বশেষ হামলার ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি এখানে হুবহু উল্লেখ করা হ’ল:
ভারত বিরোধিতার জন্যই হামলা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নুরুল হক নূরের ওপর এ নিয়ে নয়বার হামলা হলো। প্রতিবারই হামলার সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে অভিযোগ এসেছে। তবে ছাত্রলীগ সবসময় তা অস্বীকার করেছে। তবে এ দফা নুরুল হক এবং তার সহযোগীদের ওপর পরপর দু’দফায় যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার কারণ অনেককে বিস্মিত করেছে। ভিপি নূর এবং তার সহযোগীদের ওপর প্রথম দফায় হামলার ঘটনাটি ঘটে ১৭ ডিসেম্বর। ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করার সময় তাদের ওপর হামলা হয় এবং অভিযোগের আঙুল ওঠে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দিকে। তবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এমন অভিযোগ উঠে এসেছে যে, হামলার সাথে জড়িতরা ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত।
হামলার সাথে অভিযুক্তরা পরে বলেন যে, ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ নিয়ে আন্দোলন করার এখতিয়ার নেই ডাকসু ভিপি’র। এরই ধারাবাহিকতায় দু’দিন পর ডাকসু কার্যালয়ে ভিপি নূর এবং তার সহযোগীদের ওপর আবারো হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলার সময় বাতি নিভিয়ে নুরুল হক নূরসহ অনেককে নির্মমভাবে পেটানো হয়। আহত একজনকে এমনকি লাইফ সাপোর্টেও রাখতে হয়েছিল।
এবারে মি. নূরকে দায়ী করা হয় ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগত’ নিয়ে আসার জন্য। তবে হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। হামলার পর একদিকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা যখন হাসপাতালে আহতদের দেখে ‘সমবেদনা প্রকাশ’ করেছেন, অন্যদিকে দলটির কোন কোন সিনিয়র নেতা ডাকসু ভিপির উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অতীতে দেখেছি যে, ডাকসু ভিপি নূর এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে আলোচনায় থাকতে চান।’
তিনি অভিযোগ করেন যে, ছাত্রদের ‘সংশ্লিষ্ট বিষয় বাদ দিয়ে ভারতের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে’ সেখানে আন্দোলন করার চেষ্টা হয়েছে, যেগুলো ডাকসুর কাজ নয়। ‘ডাকসুর কাজ হচ্ছে ছাত্রদের বিষয়-আসয় নিয়ে কথা বলা। … সেটি না করে ভারতের বিষয় নিয়ে সেখানে আন্দোলন করার চেষ্টা, বহিরাগতদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হওয়া, এগুলো ঘটনা ঘটানোর জন্য ইন্ধন কি-না, এগুলো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।’
মি. নূরের সমর্থনে যারা কথা বলেছেন, তাদের অনেকেরই ধারণা যে, ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বাংলাদেশে যাতে নতুন করে কোন প্রতিবাদ তৈরি না হয়, সেজন্যই হামলার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ বিষয়টিকে গোড়াতেই শেষ করতে চায় সরকারপন্থী সংগঠনগুলো, মনে করছেন তার সমর্থকেরা।
সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এনিয়ে নিয়ে চলছে আলোচনা। শফিক ইসলাম নামে একজন বিবিসি বাংলার ফেসবুক পেজে মন্তব্য করেছেন, ‘নুরু-রাশেদ-রফিকের মতো ছেলেদের বেঁচে থাকা জরুরি। ভারতীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে হলে এদের কোন বিকল্প নেই’। মোহাম্মদ মানিক নামে আরেকজন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ভারতের বিরুদ্ধে কথা বললেই এরা কেন হামলা করে?’ তুহিন নামে আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘যে যাই করুক, ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। ইন্ডিয়ার বিপক্ষে কথা বলায় আবরারকে জীবন দিতে হলো। ভিপি নূরদের উপর অতর্কিতে হামলা হলো’।
অরুন্ধতী রায়ের অনুষ্ঠান : চলতি বছরের মার্চ মাসে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের সুপরিচিত লেখক অরুন্ধতী রায়। ঢাকায় দৃক গ্যালারির আয়োজনে ছবি মেলায় যোগ দিতে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। তখন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের সাথে অরুন্ধতী রায়ের একটি কথোপকথনের অনুষ্ঠান ছিল। সে অনুষ্ঠানের জন্য প্রথমে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল ঢাকার খামার বাড়ির কৃষিবিদ ইন্সটিটিউট। তবে পরে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়েছে যে, ‘অনিবার্য পরিস্থিতির’ কারণে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হল। পুলিশ এজন্য নির্দিষ্ট কোন কারণ না জানালেও তখন অভিযোগ উঠেছিল যে, অরুন্ধতী রায় যেহেতু ভারতের বর্তমান সরকারের একজন কড়া সমালোচক, সেজন্য তার অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বেশ তাড়াহুড়া করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে অন্য একটি স্থানে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়েছিল।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী বিক্ষোভ : সুন্দরবনের কাছে রামপালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশে আপত্তি উঠেছিল। আর যে বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার সামনের কাতারে ছিল বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন। এ আন্দোলন করার সময় কয়েক দফায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় সরকারপন্থী সংগঠনের হামলার শিকার হয়েছিল আন্দোলনকারীরা। রামপালে প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা তখন বারবার বলেছেন যে, ওই আন্দোলনের সাথে ভারত বিরোধিতার কোন সম্পর্ক নেই বরং বিষয়টি পুরোপুরি পরিবেশগত। কিন্তু বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন যে, ওই আন্দোলনের সাথে ভারত বিরোধিতার একটি সম্পর্ক আছে এমন ধারণা সরকারপন্থী সংগঠনগুলোর কারো কারো মধ্যে রয়েছে।
রামপাল বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে ছিল, তখন জ্বালানী এবং বিদ্যুৎ খাতের ম্যাগাজিন ‘এনার্জি ও পাওয়ার’-এর সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই একটি প্রচারণা আছে যে, ভারতীয় অংশে সুন্দরবনের কাছে প্রকল্পটি করতে না পেরে তা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
মি. হোসেন বলেন, ‘অনেকে মনে করছেন ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট চাইলেই এটি বন্ধ হয়ে যাবে। যেহেতু বাংলাদেশের সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, সেজন্য প্রকল্পের বিরোধিতাকারীরা এটাকে অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান সেন্টিমেন্ট হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে’।
ভারত বিরোধিতা নিয়ে সমস্যা কোথায়? : ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেও বাংলাদেশের সাবেক ক‚টনীতিকদের অনেকেই অস্বস্তি বোধ করেন। অনেকেই নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে চাননি। বক্তব্যে ভারত বিরোধিতা প্রকাশ পেলে কোন ধরনের ঝামেলায় জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে কারো কারো মনে। এদের কেউ কেউ মনে করছেন, বিষয়টির একটি রাজনৈতিক মাত্রা আছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে গত প্রায় এগারো বছর যাবত ভারতের বেশ ভালো সম্পর্ক বজায় রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনে ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। ফলে ভারতের উপর বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের এক ধরনের রাজনৈতিক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
বাংলাদেশের সাবেক একজন ক‚টনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে যে ধরনের সম্পর্ক চলছে সেটি ‘সুষ্ঠু সম্পর্কের’ জন্য ইতিবাচক নয়।
স¤প্রতি ডাকসু ভিপি নূরের উপর হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যে কোন ইস্যুতে দেশ কিংবা বিদেশ বলে কোন কথা নেই। আমাদের স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত যে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে’। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করেছে, তখন বাংলাদেশে আমেরিকা বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে না?’
বাংলাদেশের সাবেক আরেকজন ক‚টনীতিক হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক এবং বাস্তবতার ভিত্তিতেই এ সম্পর্ক নির্ধারিত হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। মি. কবির বলেন, ‘এখানে যত বেশি খোলামেলা আলাপ-আলোচনা হবে এবং যুক্তি-তর্ক হবে, সম্পর্ক ততই শক্তিশালী হবে’।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-