২০১৯ সালে হারিয়ে গেলেন যারা

বিনোদন ডেস্ক ◑  শোবিজে শূন্যস্থান বেড়েই চলেছে। যাদেরকে ঘিরে এক সময় শোবিজের আঙিনা আলোকিত হয়ে থাকতো তাদের অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছেন একে একে। চলতি বছরেও শোকের মিছিল ছিলো শোবিজে। একঝাঁক গুণী মানুষ হারিয়ে গেলেন।

২০১৯ সালে মৃত্যুর মিছিলে সামিল হওয়া মানুষদের তালিকাটা বেশ লম্বা। প্রিয়জনদের চোখের জলে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন তারা। রেখে গেছেন কাজ আর স্মৃতিমুখর দিন। এক নজর দেখে আসা যাক, আমারা যাদের হারালাম এই বছর।

ইফতেখারুল আলম
বছরের শুরুতেই ৫ জানুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ষাটের দশকের সিনেমার প্রখ্যাত প্রযোজক ইফতেখারুল আলম। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগসহ নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হানের পরিচালনায় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’ নির্মিত হয় তার প্রযোজনায়। চলচ্চিত্র জগতের মানুষদের কাছে তিনি ইফতেখারুল আলম কিসলু নামে পরিচিত।

১৯৬৬ সালে রাজ্জাক-সুচন্দা জুটির প্রথম ছবি ‘বেহুলা’ও নির্মিত হয় তার প্রযোজনায়। স্বাধীনতার পর প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা ১১ জন’ও প্রযোজনা করেন তিনি। এছাড়া ‘আনোয়ারা’, ‘আলিবাবা’ ও ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সংসার’র মতো অসংখ্য ছবি প্রযোজনা করেছেন।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
বছরের প্রথমদিকে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে শূন্যতা তৈরি করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আরও এক নক্ষত্র। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ৭০ দশকের শেষ লগ্ন থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পসহ সংগীতশিল্পে সক্রিয় ছিলেন বুলবুল। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুরকার ছিলেন তিনি।

শাহনাজ রহমতউল্লাহ
মার্চ মাসে সবাইকে ছেড়ে চলে যান কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ। ২৩ মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ বাসায় মারা যান তিনি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সংগীতজীবনে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে, এবার বল’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’সহ অসংখ্য কালজয়ী গান উপহার দিয়ে গেছেন তিনি। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন।

পাঁচ গুণীজন হারানো এপ্রিল
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মারা গেছেন বেশ ক’জন গুণীজন। গীতিকার আহমেদ কায়সার, খ্যাতিমান অভিনেতা টেলি সামাদ, অভিনেতা সালেহ আহমেদ, নির্মাতা হাসিবুল ইসলাম মিজান ও কৌতুক অভিনেতা আনিস না ফেরার দেশে চলে গেছেন এই মাসে।

‘পাগল মন’ গানের গীতিকার আহমেদ কায়সার গত ১ এপ্রিল পটুয়াখালী জেলার চরখালী গ্রামে নিজ বাসভবনে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন সন্তানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

গুণী অভিনেতা টেলি সামাদ গত ৬ এপ্রিল স্কয়ার হাসপাতালে মারা গেছেন। সত্তর ও আশির দশকের শক্তিমান এ অভিনেতার প্রকৃত নাম আবদুস সামাদ। অভিনয়ের জন্যই তিনি ‘টেলি’ উপাধি পান। শুধু অভিনয় নয়, গান ও ছবি আঁকাতেও ছিল তার সমান পারদর্শিতা।

১৮ এপ্রিল ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন হাসিবুল ইসলাম মিজান। তার পরিচালিত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘প্রেমের কসম’ ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ ‘জন্ম’ ‘কপাল’ ও ‘তুমি আছো হৃদয়ে’।

টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের বর্ষীয়ান অভিনেতা সালেহ আহমেদ গত ২৪ এপ্রিল রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ১৯৯১ সালে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। ধারাবাহিক ‘অয়োময়’ নাটক এবং ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিনয় জগতে তার পদচারণা শুরু। এই অভিনেতা পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক।

কৌতুক অভিনেতা আনিসুর রহমান আনিস। গত ২৯ এপ্রিল রাজধানীর টিকাটুলীর অভয় দাস লেনের বাসায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আনিস চলচ্চিত্রে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন অভিনেতা নয়, চিত্রসম্পাদক হিসেবে।

খালিদ হোসেন
মে মাসে সবাইকে ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছেন বরেণ্য নজরুলসংগীত শিল্পী খালিদ হোসেন। গত ২২ মে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। দীর্ঘদিন হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। খালিদ হোসেনের গাওয়া নজরুলসংগীতের ছয়টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২০০০ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। আরো পেয়েছেন নজরুল একাডেমি পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক, কলকাতা থেকে চুরুলিয়া পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা।

সুবীর নন্দী
মে মাসে হারিয়ে গেছেন আরও এক গুণীজন। তিনি সবার প্রিয় কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। গত ৭ মে দেহত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের এমআইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ৬৬ বছর বয়সী সুবীর নন্দী দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন। দীর্ঘ ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে আড়াই হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন সুবীর নন্দী। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। পেয়েছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা ও অনেক স্বীকৃতি।

মায়া ঘোষ
গত ১৯ মে মারা গেলেন অভিনেত্রী মায়া ঘোষ। ২০০০ সালে মায়া ঘোষের ক্যান্সার ধরা পড়ে। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার সরোজ গুপ্ত ক্যান্সার হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু হয়। ২০০৯ সালের দিকে অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর কিডনি, লিভার ও হাঁটুর সমস্যা দেখা দেয়। এতসব সমস্যার সঙ্গে পেরে উঠেননি এই অভিনেত্রী। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে নিজেকে নিয়ে গেলেন অদেখা ভুবনে।

এছাড়া মে মাসে মারা গেছেন মঞ্চ ও ছোট পর্দার অভিনয়শিল্পী তমা খান। গত ৮ মে রাজধানীর মিরপুরে তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মিরপুরের ভাড়া বাসায় ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়।

মমতাজউদ্দীন আহমেদ
জুন মাসে সবাইকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষাসৈনিক মমতাজ উদ্দীন আহমদ। নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৯৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। চলতি বছরের ২ জুন না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।

নাজমুল হুদা মিন্টু
চলচ্চিত্র নির্মাতা নাজমুল হুদা মিন্টুও গত ২ জুন মারা গেছেন। ‘সূর্য ওঠার আগে’, ‘চৌধুরী বাড়ী’, ‘ডাক পিয়ন’, ‘অনেক প্রেম অনেক জ্বালা’, ‘দিনের পর দিন’, ‘সংঘর্ষ’, ‘মধুমালতি’, ‘ঘরে বাইরে’সহ বেশ কিছু সিনেমা নির্মাণ করেন তিনি।

খলিলুর রহমান বাবর
চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক খলিলুর রহমান বাবর মারা যান ২৬ আগস্ট। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬৭ বছর। ‘বাংলার মুখ’, ‘রংবাজ’সহ তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। মাঝে প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবেও তিনি আত্মপ্রকাশ করেন।

কালিদাস কর্মকার
অক্টোবর মাসে বিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকার। গত ১৮ অক্টোবর ইস্কাটনের বাসায় অচেতন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। পরে পরিবারের সদস্যরা ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মোহাম্মদ জাকির খান
রাজধানীর উত্তরায় আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালে গত ১৮ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নির্মাতা মোহাম্মদ জাকির খান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। তিনি স্ত্রী, চার মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

হুমায়ূন সাধু
তরুণ নাট্য নির্মাতা ও অভিনেতা হুমায়ূন সাধু। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ অক্টোবর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিনেমা নির্মাণের স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই বিদায় নিতে হলো তাকে।

কালা আজিজ
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা আজিজ। চলচ্চিত্রে ‘কালা আজিজ’ নামে পরিচিত ছিলেন গুণী এই শিল্পী। গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।

মাহফুজুর রহমান
দশবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খান। গত ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাহফুজুর রহমান খান ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক আবদুল লতিফ বাচ্চুর শিষ্য। তাঁর অধীনে সহকারী চিত্রগ্রাহক হিসেবে ১৯৭০ সালে ‘দর্পচূর্ণ’ ও ১৯৭১ সালে ‘স্বরলিপি’ চলচ্চিত্রে কাজ করেন।

সূচনা
অকালে চলে গেলেন মডেল, অভিনেত্রী সূচনা ডলি। কিডনি সমস্যার কারণে শুক্রবার ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

পৃথ্বী রাজ
তরুণ শিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক পৃথ্বী রাজ। গত ১৫ ডিসেম্বর নিজের স্টুডিও জিলাপিতে কাজ করার সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। বছরের শেষ দিকে শোকের মিছিলটা ভারী করে দিয়ে গেলেন তরুণ এই প্রিয়মুখ।

আরও খবর