হাসিনার রেকর্ড

নবমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি আওয়ামী লীগে আছি, এখানেই থাকবো। এটাই আমার পরিবার। ’৭৫ সালে আমি মা-বাবা, ভাইবোন হারিয়ে বিশাল এক পরিবার পেয়েছি। সেটা হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরিবার। গতকাল দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের কাউন্সিলে তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের দায়িত্বে আছি। ৩৯ বছর চলছে। আমি কোনো পদে থাকি বা না থাকি আওয়ামী লীগে আছি, এখানেই থাকবো।
এটাই আমার পরিবার। আমার আপনজন যাদের রেখে গিয়েছিলাম তাদের কাউকে পাইনি। তবে আমি পেয়েছিলাম বিশাল একটা পরিবার, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নেতাকর্মীদের ভালোবাসাই আমার চলার পথের শক্তি। আমার অর্থ, সম্পদ নেই। নেতাকর্মীদের ভালোবাসাই আমার একমাত্র শক্তি। সেজন্য চেষ্টা করেছি সংগঠনকে গড়ে তুলতে। তবে সামনে আপনাদের ভাবতে হবে। আমার ৭৩ বছর বয়স হয়েছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না। নতুন নেতা নিয়ে ভাবতে হবে। দলকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয়বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় ওবায়দুল কাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, এবার আপনারা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন নতুন পর্ষদ গঠনের। ওবায়দুল কাদের পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। আর সভাপতি হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন।

আমি আমার সাধারণ সম্পাদককে অভিনন্দন জানাই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করছি। ছাত্রলীগ থেকেই আমাদের সবার যাত্রা শুরু। শেখ হাসিনা বলেন, যে গুরুদায়িত্ব আপনারা আমাকে দিয়েছেন তা যেন যথাযথভাবে পালন করতে পারি তার জন্য সবার দোয়া চাই, সমর্থন চাই। এর আগে গতকাল সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্ব কাউন্সিল অধিবেশনের শুরুতে দেয়া ভাষণে তিনি আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন শেখ হাসিনা। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে নির্মিত প্যান্ডেলে অনুষ্ঠিত হয় অধিবেশন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে, মানুষ যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে আমাদেরকে নির্বাচিত করে এবং আমরা যেন দেশসেবা করে যেতে পারি। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারি। আর জাতির পিতার যে আদর্শ সেই আদর্শ মেনেই চলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৯টি বছর এদেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলেছে তাদের বিরুদ্ধে যত সংগ্রাম ও আন্দোলন এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার যত সংগ্রাম আওয়ামী লীগই সে সংগ্রাম করেছে এবং আওয়ামী লীগই এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। তিনি বলেন, বাঙালির জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করা, একে উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলে বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়েই জাতির পিতা তার সারাটি জীবন উৎসর্গ করে যান।

দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য তিনি আজীবন জেল, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে গেছেন। জাতির পিতার অবদান ও আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনভাবে সংগঠনটি গড়ে তোলেন, এর মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেন। তিনি বলেন, বাংলার জনগণকে জাতির পিতার স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনকালে জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারেন নাই। সেই স্বপ্ন পূরণই তার রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার বাবা-মা’য়ের আত্মা যেন শান্তি পায়। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেই রক্ত যেন বৃথা না যায়, সে লক্ষ্য নিয়েই তার সরকার কাজ করে বিগত ১০ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। লক্ষ্য আরো অনেক দূর যেতে হবে। সেজন্য সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য কাজ করে যাওয়ায় নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানিয়ে বলেন,দেখা যায় যে, অনেকেই ক্ষমতায় আসার পরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু আমরা সেটা পেরেছি।

মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছি। সেক্ষেত্রে আমি বলবো সকলকে সেই চিন্তা থেকেই কাজ করতে হবে। তিনি বলেন,বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন এবং জাতির যে কোন ক্রান্তি লগ্নে এর নেতা-কর্মীরা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করেছে। প্রতিটি কাউন্সিলরকে এটা মাথায় রাখতে হবে- জাতির পিতার সেই আদর্শ নিয়েই আমরা দেশকে গড়ে তুলবো। তিনি বলেন,জাতির পিতা স্বাধীনতার পরে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ গড়ে তুলে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে গিয়েছিলেন আর এরপরেই জাতির জীবনে ১৫ই আগস্ট বিপর্যয় নিয়ে আসে। ’৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর এদেশে যে হত্যা, ক্যু এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। যেখানে গণতন্ত্র ছিল না, কারফিউ গণতন্ত্র ছিল। যেখানে সেনাতন্ত্র ছিল, সামরিক স্বৈরশাসকরা রাষ্ট্র শাসন করেছে দীর্ঘ ২১ বছর, এরপর আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জনগণ যে সরকারের সেবা পেতে পারে, জনগণের কল্যাণ করতে পারে, তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে, এটা কেবল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই জনগণ উপলদ্ধি করতে পেরেছে। তিনি বলেন, উড়ে এসে জুড়ে বসারা সবসময় নিজেদের ভাগ্য নিয়ে এবং অসৎ উপায়ে ক্ষমতা দখলকে বৈধ করার কাজেই ব্যস্ত ছিল। তারা জনগণের কথা চিন্তা করে নাই। সরকার প্রধান বলেন,এদেশে ঋণ খেলাপি কালচার, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করাসহ পুরো সমাজটাকে তারা ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়।

যে সরকারের কোন নীতি আদর্শ থাকে না, কোন লক্ষ্য থাকে না, সে সরকার চলে কি করে। তিনি এ সময় জাতির পিতার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং জাতির পিতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের গোপন প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশিত ১৪ খন্ড ভলিউমের বইগুলো দলের প্রতিটি নেতা-কর্মীকে পড়ার পরামর্শ দেন। কারো বিরুদ্ধে প্রকাশিত গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে অদ্যাবধি কেউ কোন পুস্তক রচনা না করলেও জাতির পিতা কিভাবে দেশের কল্যাণে কাজ করে গেছেন, তার বিরুদ্ধে কি কি ষড়যন্ত্র হয়েছিল, কি কি অপপ্রচার হয়েছিল সেগুলো তুলে ধরার জন্যই ’সিক্রেট ডকুমেন্ট অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক এ সংক্রান্ত বইগুলো তিনি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও উল্লেখ্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কাউন্সিলরদের উদ্দেশ্যে বলেন,বইগুলো থেকে আপনাদের অনেক কিছু শিক্ষা নেয়ার আছে।

আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ: ওবায়দুল কাদের
এদিকে দলের প্রতিটি পর্যায়ে দূষিত রক্ত বের করে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করা হবে বলে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কাউন্সিলে তিনি বলেন,দল থেকে আজকে দূষিত রক্ত বের করে দিতে হবে, বিশুদ্ধ রক্তের সঞ্চালন করতে হবে। যে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে তা থেমে যায়নি। সকলের রিপোর্ট আমাদের কাছে রয়েছে, ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপরাধীরা নজরদারিতে রয়েছে। তিনি বলেন,সরকারের মধ্যে দলকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না, দল শক্তিশালী না হলে সরকার শক্তিশালী হবে না। কিছু-কিছু জায়গায় মাঝে-মধ্যে দ্বন্ধ-কলহ দেখা যায়। এসব বিরোধ বন্ধ করতে হবে। আমাদের হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ নেতাকর্মী। বিতর্কিত লোকজন আমাদের দরকার নেই। শীতের অতিথি পাখিরা সুসময়ে আসে, দুঃসময়ে তারা থাকবে না। সেই মৌসুমি পাখিদের আমাদের দরকার নেই। বাংলাদেশ ও জনগণকে বাঁচাতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে হলে আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে। আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হলে দলের নেতাকর্মীদের বাঁচাতে হবে। আর বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। এদিকে সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর গতকাল বিকেলে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ কাজ করবে বলে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন,আমরা প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবি না। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চাই। এজন্য বিরোধী দলের প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল। তারা কোনও সভা-সমিতি করতে চাইলে আমরা তাদের সে সুযোগ দিতে চাই।

তিনি বলেন,আমাদের অফিসে আক্রমণ হয়েছিল। আমরা আক্রান্ত হয়ে পাল্টা আক্রমণ করিনি। তবে জনগণের জানমালের স্বার্থে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু আমরা করেছি। সেতুমন্ত্রী বলেন,নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছেন নেত্রী শেখ হাসিনা। জনগণের কাছে তিনি অঙ্গীকার করেছেন, প্রত্যেক পরিবারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। সেই প্রতিশ্রুতি আমরা পূরণ করবো। এগুলো আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, আমাদের মূল ফোকাস হলো মুজিববর্ষের বিশাল প্রোগ্রাম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। এটা আমাদের একটা বিরাট দায়িত্ব। এছাড়া ভিশন-২০২১ ও ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়নও আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে। আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সুশৃঙ্খল ও ঐতিহাসিক বলে মন্তব্য করে নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের এখনও অনেক কাজ বাকি। আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। আমরা গণতান্ত্রিক দল। সাধারণ সম্পাদক পদে আসার মতো যোগ্যতা আমার নেই। আমি অসুস্থতা থেকে আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি। মমতাময়ী মায়ের মতো তিনি (শেখ হাসিনা) আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। কলিগরাও অনেক কষ্ট করেছেন। দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত করার জন্য শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শেখ রেহানাকেও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আরও খবর