স্বপ্নের কক্সবাজার

শামসুল হক শারেক ◑

সমুদ্র ভালো লাগে না এমন মানুষের দেখা ভার। সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, সামনে সমুদ্র। নীল পানিরাশি আর শোঁ শোঁ গর্জনে মনোমুগ্ধকর সৈকত। যেখানে সূর্যের আলোয় সিক্ত হয়ে রূপালি ঢেউয়ের উপর আছড়ে পড়ে। দূর সীমানায় রক্তিম সূর্য আর পানসে নীল সাগর একে অপরকে আলিঙ্গন করে। এমন অনবদ্য সৌন্দর্যের আয়োজন নিয়েই দেশের দক্ষিণ-প‚র্ব উপক‚লে রচিত হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার।

দেশের ভিতরে কোথাও ভ্রমণের পরিকল্পনা করলে দেখা যায় প্রথমে অবশ্যই কক্সবাজারের নাম এসে যায়। ইতোমধ্যে হাজার হাজার পর্যটকে মুখরিত বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। আপনি হয়তো যাবেন যাবেন বলে ভাবছেন, তাহলে দেরি কেন? আপনার জন্যই আজকে কিভাবে একটি সুন্দর কক্সবাজার ভ্রমণ করা যায় তার খুঁটিনাটি তুলে ধরা হয়েছে।
কলাতলী ও লাবণী সৈকত : জেলা শহর থেকে নিকটে হওয়ার কারণে কলাতলী এবং লাবণী সৈকত পর্যটকদের নিকট প্রধান আকর্ষণ বলে গণ্য হয়ে থাকে। সৈকতের এই দুইটি পয়েন্টের মাঝের দূরত্ব মাত্র পনের মিনিট। লাবণী পয়েন্টে পাওয়া যায় ঝিনুক মার্কেট এ ছাড়া ছোট-বড় অনেক দোকান যেখানে নানারকম জিনিসের পসরা সাজিয়েছে দোকানিরা পর্যটকদের জন্য অপেক্ষা করে। আর কলাতলী সৈকতে আছে বেশকিছু রেস্টুরেন্ট, যেখানে বসে এক মগ কফি পান করতে করতে মনোরম সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়।

হিমছড়ি : মেরিনড্রাইভ ধরে কক্সবাজার থেকে ১৮ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত। সবুজ পাহাড় আর অপরুপ ঝর্ণা এখানকার প্রধান আকর্ষণ। হিমছড়ি যাওয়ার পথে আর একটি আকর্ষণ হল, পথের বামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ ঘেরা পাহাড় আর ডানদিকে সমুদ্রের নীল পানিরাশি থেকে ধেয়ে আসা অনবরত ঢেউয়ের খেলা। বর্ষা মৌসুমে হিমছড়ির ঝর্ণা অধিক জীবন্ত ও প্রাণবন্ত থাকে। এখানে পাহাড় চ‚ড়ায় একটি রিসোর্টও রয়েছে, যেখান থেকে নীল পানিরাশির বিশাল সমুদ্রকে সহজেই দেখা যায়।

ইনানি সৈকত : সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণীয় এলাকাগুলির মধ্যে অন্যতম ইনানী সৈকত। কক্সবাজার থেকে এর দূরত্ব ৩৫ কি.মি.। অভাবনীয় সৌন্দর্যে ভরপুর এই সৈকতটি দিনকে দিন অধিক পর্যটক প্রিয় একটি জায়গা হিসেবে পরিচিত লাভ করছে। আমরা জানি ইনানি পরিস্কার পানির কারণে পর্যটকদের কাছে সমুদ্রস্নানের উৎকৃষ্ট স্পট বলে বিবেচিত। ভাটার সময় এখানকার সমুদ্রের মাঝে অনেক প্রবাল পাথর দেখা যায়।

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক : প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত নির্জন উঁচু-নিচু টিলা, প্রবহমান ছড়া, হ্রদ, বিচিত্র গর্জনের মতো সুউচ্চ ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক বৃক্ষ চিরসবুজ বনের জানা-অজানা গাছ-গাছালি, ফল-ভেষজ উদ্ভিদ, লতার অপ‚র্ব উদ্ভিদের সমাহার ও ঘন আচ্ছাদনে গড়ে উঠেছে এ সাফারি পার্ক।

ছায়াঘেরা পথ, সবুজ বনানী, জানা-অজানা গাছের সারি, পাখি আর বানরের কিচিরমিচির সব কিছু মিলিয়ে যেন এক অসাধারণ অনুভ‚তি। এ পার্কে স্বাদু পানির কুমির যেমন আছে, তেমনি আছে লোনা পানির কুমির। এখানে বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে জেব্রা, বাঘ, সিংহ, হাতি, ভালুক, গয়াল, জলহস্তী, মায়া হরিণ, সাম্বা হরিণ, চিত্রা হরিণ, প্যারা হরিণসহ পাখ-পাখালির সমাহার। পথের ধারে উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠে যে কেউ দেখতে পারবেন পুরো পার্কের সীমানা পর্যন্ত। উপভোগ করতে পারবেন অপার সৌন্দর্য। রয়েছে তথ্য শিক্ষাকেন্দ্র, প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক জাদুঘর এবং বিশ্রামাগার রয়েছে।
এছাড়া কক্সবাজার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় অন্য স্থানগুলির মধ্যে মেরিন ড্রাইভ সড়ক, বার্মিজ বাজার, শুটকি বাজার, লাইট হাউস, মাহাসিংদোগী, মাথিনের ক‚প, বদর মোকাম মসজিদ, চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, লবণ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, কানা রাজার সুড়ং, শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ শাপলা সমুদ্র সৈকত ইত্যাদি। শহরের ঝাউতলা এলাকায় স্থাপিত পর্যটক আকর্ষণে সাগর তলের রহস্য নামে রেডিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড ফিসে পর্যটকরা আঠার মত লেগে থাকেন সারা বছর।

যাতায়াত : যারা ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তাদের জন্য বাসের পাশাপাশি রয়েছে বিমানের সুবিধা। তাছাড়া ট্রেনে করে চট্টগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে কক্সবাজার যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে কক্সবাজার বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় দশ থেকে বার ঘণ্টা, বিমানে ৫০ মিনিট। এসি/ননএসি দুই ধরনের বাস আছে। বাস ভেদে ননএসি/এসিভাড়া ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। ঢাকা থেকে প্রতিদিনই অনেক বাস পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সেন্টমার্টিন পরিবহন, গ্রীন লাইন পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, শ্যামলী, এস আলম, হানিফ, সৌদিয়া, টিআর ট্রাভেলস। ঢাকা কমলাপুর থেকে চিটাগাং মেইল, তুর্ণা নিশিথা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর গোধ‚লীসহ একাধিক ট্রেন চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আকাশ পথে বাংলাদেশ বিমান, নভোএয়ার, ইউএস বাংলা, রিজেন্ট এয়ার ওয়েজ, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ক্লাস ভেদে ঢাকা-কক্সবাজার-ঢাকা রিটার্ন টিকিট দশ থেকে সাড়ে এগার হাজার টাকা তবে ইদানিং বিভিন্ন বিমান সংস্থার প্রায় সারা বছরই ডিসকাউন্ট অফার থেকে থাকে। সেক্ষেত্রে ভাড়া অনেক কম হয়ে থাকে।
থাকার ব্যবস্থা : বর্তমানে কক্সবাজারে থাকার জন্য ফাইভ স্টার ক্যাটাগরির অনেক হোটেল হয়েছে। ফোরস্টার ও থ্রিস্টার বা সমমানের হোটেল ও রিসোর্টের সংখ্যাও কম নয়। সৈকতের নিকটের বেশিরভাগ হোটেলই ভাল মানের। হোটেল ও রিসোর্ট কলাতলী ও লাবণী পয়েন্টে অবস্থিত। ইনানির নিকটবর্তী এলাকাতেও থাকার জন্য বেশকিছু হোটেল গড়ে উঠেছে। এছাড়া এর বাইরে আছে ইকো রিসোর্ট। মৌসুম ভেদে অর্থাৎ পিক ও অফ-পিক অনুযায়ী রুমের ভাড়ার মধ্যে তারতম্য হয়। বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পিক এবং মে থেকে আগস্ট অফ-পিক টাইম হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। অফ-পিক টাইমে হোটেল ও ক্লাস ভেদে রুম ভাড়া ২৫-৫০শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। সৈকত থেকে একটু দূরত্বে সাধারণ মানের অনেক হোটেল রয়েছে।

নিরাপত্তা : কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি জিল্লুর রহমান জানান, কক্সবাজারের পর্যটন এলাকাগুলোতে টুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধান ও আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়নে পুলিশের কোন প্রকার চেষ্টার কোন কমতি নেই। তাই কক্সবাজারে পর্যটকরা আসতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন এবং নিরাপদ বোধ করেন।

আরও খবর