তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, তোমাদের যেকোনো দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়ার পরশ।’ (সূরা তাওবা : ১২৮)।
মানবতার ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো মানবদরদী আর নেই। মানবসভ্যতার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছেন তিনি।
মাত্র ২৩ বছরের অল্প সময়ে পৃথিবীজুড়ে যে শান্তির মিশন বাস্তবায়ন করেছেন তার দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর ছিল না অর্থ-ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি, ছিল না ক্ষমতার দাপট। পৃথিবী তখন নিকষ আঁধারে নিমজ্জিত। জাহেলিয়াতের অন্ধকারে মানুষ জ্ঞানশূন্য। যারা পশুর চেয়েও নিচে নেমে গিয়েছিল। মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। মানবতার সেই সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে মাত্র গুটিকয়েক অনুসারী নিয়ে আরবের ক্ষুধা-অনাহারে জর্জরিত, বর্বরতা ও মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে সুখ-সমৃদ্ধি, মর্যাদা ও গৌরবের সোনালি মানুষে রূপান্তর করেছেন। অথচ আজ পৃথিবীতে মুসলমানদের সংখ্যা কোটি কোটি। তাদের আছে ধনসম্পদ কাঁড়ি কাঁড়ি, নেই কোনো অভাব-অনটন। অধুনিকতার ছোঁয়ায় তারা এখন আকাশে ভাসছে। তথাপি তারা নানাভাবে পিছিয়ে।
আমাদের ঝিমিয়ে পড়া আত্মাকে শক্তিশালী করতে এবং প্রাণহীন সভ্যতাকে প্রাণবন্ত করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিন্তা-চেতনাকে লালন করতে হবে এবং তাঁর আদর্শকে আবার বুকে ধারণ করতে হবে, যিনি অন্তরের স্বচ্ছতা, আত্মার মহত্ত্ব, ধৈর্য, সহনশীলতা, সততা, বিনম্রতা, বদান্যতা, বিশ্বস্ততা, সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতাসহ সর্বোত্তম চরিত্রের প্রবাদপুরুষ ছিলেন। যিনি ছিলেন একাধারে স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহশীল, ছিলেন বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সমাজ সংস্কারক, সাহসী যোদ্ধা, ন্যায়বিচারক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্মপ্রচারক। মোটকথা কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ ও পথিকৃৎ। তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহজাব : ২১)।
বিশ্বনবী সা:-এর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিষ্টান লেখক উইলিয়াম মুর বলেছেন, ‘মুহাম্মদ সা: যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।’
১৯৭৮ সালে মাইকেল এইচ হার্ট ‘ঞযব ঐঁহফৎবফ’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইয়ে যুগযুগান্তের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ১০০ জন ব্যক্তির জীবনী উল্লেখ করেছেন। তিনি ইতিহাস অনুসন্ধান করে সেসব ব্যক্তির জীবনী এ গ্রন্থে স্থান দিয়েছেনÑ যারা বিশ্বের মানবজাতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। এ গ্রন্থে আইজ্যাক নিউটন, অ্যারিস্টটল, গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, যিশু, হিটলার, প্লেটো এবং মহাত্মা গান্ধীসহ বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি শুধু এই ১০০ জনের তালিকা করেই দায়িত্ব পালন শেষ করেননি; বরং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের জীবনের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো একত্রিত করে সেগুলোর যথার্থ মূল্যায়নও করেছেন এবং সেই দিক থেকে যাকে যেভাবে পরিচিতি করা প্রয়োজন ঠিক তাই করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলোÑ এই বিখ্যাত গ্রন্থে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে মূল্যায়ন করে যে স্থানটি নির্ধারণ করেছে, তার মধ্যে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর স্থান হচ্ছে সর্বপ্রথম। একজন অমুসলিম গবেষকের নিরপেক্ষ গবেষণায় নবী মুহাম্মদ সা:ই বিশ্বের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। মাইকেল এইচ হার্ট নিজের বক্তব্যের দৃঢ়তা প্রদর্শন করে বলেছেনÑ ‘আমি একজন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হয়েও হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রথম স্থানে রাখায় হয়তো অনেকেই চমকে যাবেন, বাস্তবেই এমনটি হওয়ার কথা। কিন্তু সত্যি বলতে কি, তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রে সফলতার আকাশ ছুঁয়েছেন। তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় ঠেকেছিল। তিনি সেই প্রতিকূলের মধ্যে একজন রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় সফল নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ইসলামের শান্তির মিশন বাস্তবায়ন করে এক বিশাল রাজত্ব গড়ে তোলেন এবং ইসলামকে বিশ্বের বুকে একটি শ্রেষ্ঠ ধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। যার দাপট আজ অবধি দুনিয়াজুড়ে বিরাজমান।’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহত্ত্ব অনুভব করতে সেই বিস্ময়কর সমাজ সংস্কার আন্দোলন উল্লেখ করাই যথেষ্ট, যা আরব ভূখণ্ডের চেহারা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আরব জাতিকে অজ্ঞতার অভিশাপ ও মূর্তিপূজার দুর্ভাগ্য থেকে বের করেছেন। যারা ছিল ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত, বহুরূপী মূর্খতায় দিকভ্রান্ত এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। নবুওয়াতের পূর্বাপর ইতিহাস পড়লে যে কেউ চমকে যাবে এবং থমকে দাঁড়াবে, সেখানে মানুষ হতাশায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ফিতরাত নষ্ট পথে বিচরণ করছিল, প্রবৃত্তি তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে, দাম্ভিকতায় তাদের পা আকাশে চড়ে, তাদের বর্বরতা ও ভ্রষ্টতা দেখে শয়তানও লজ্জা পেত। বিশ্বনবীর আগমনের আগে তাদের হিংস্রতা, পাশবিকতা ও নারকীয়তা যে স্তরে পৌঁছে ছিল; সে নিষ্ঠুরতার গল্প শুনলে শিউরে উঠতে হয়। দারিদ্র্যের ভয়ে বাবা নিজের সন্তানকে হত্যা করত। লজ্জা ও গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে নিজের কন্যাসন্তানকে জীবিত দাফন করা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। বাজারে পণ্যের মতো দাসদাসী বিক্রি হতো। ধর্মের নামে মানুষ বলি হতো। মারামারি-কাটাকাটি সব সময় লেগেই ছিল। ন্যায়নীতির নামগন্ধও ছিল না। ধনী গরিবের ওপর জুলুম করত। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার অপব্যবহার করত। মোটকথা চারদিকে ছিল শুধু অন্যায় ও নৈরাজ্যের অমানিশা। ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীতে বর্ষিত হয় রহমতের শবনম, জাতির ভাগ্যাকাশে উদয় হয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম। তিনি মানবসভ্যতার এক মহান সংস্কারক।
তাঁর অবিশ্রান্ত সংগ্রাম ও প্রচেষ্টায় আরবের পরবর্তী যে চেহারা, সেটি হলো পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসের সর্বশেষ্ঠ যুগ। সব অন্যায়, অসত্য, শোষণ ও জুলুমের রাজত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়। আরবের বর্বর ও অসভ্য জাতি সুশৃঙ্খল ও সভ্য মানবে রূপান্তর হয়। যারা সমকালীন ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও হয় আলোকবর্তিকা।
রাশিয়ান বিখ্যাত লেখক টলস্টয় বলেন, ‘নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। মানবসমাজকে এগিয়ে নিতে তাঁর ভূমিকা তুলনাহীন। তাঁর সফলতার দলিল হিসেবে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বর জাতিকে সত্যের আলোর দিশা দিয়ে তাদেরকে তিনি শান্তি ও নিরাপত্তায় ফিরিয়ে আনেন। নিজে সাদামাটা জীবন প্রধান্য দিয়েছেন। রক্তপাত ও মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন। মানবতার জন্য উন্নতি, সমৃদ্ধি ও সভ্যতার পথ বিকশিত করেছেনÑ যা কেবল একজন শক্তিমান ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। এমন মহান মানবের জন্য হাজারো স্যালুট।’
বিশ্ববিখ্যাত লেখক জর্জ বার্নার্ড শ বলেন, ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধর্মের প্রতি লাখো শদ্ধা। আমি তাঁর বিস্ময়কর প্রাণশক্তি দ্বারা মুগ্ধ। আমার বিশ্বাস পৃথিবীর বুকে এটিই একমাত্র ধর্ম, পরিবর্তনশীল জীবনের সাথে রয়েছে যার অপার সামঞ্জস্য, প্রতিটি যুগের সাথেই রয়েছে তার উপযুক্ততা। আমি এই মহান মানবের জীবনী পাঠ করে মনে হলো, তাঁর নাম হওয়া উচিত মানবতার মুক্তিদাতা।’
সত্যিই তিনি হলেন মানবতার মুক্তিদাতা, তাঁর আনীত ধর্ম হলো জীবনঘনিষ্ঠ ও সৌভাগ্যতায় পরিপূর্ণ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত ধরেই সভ্য পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি, উন্নতি ও অগ্রগতির চিন্তার সূচনা হয়েছে। তিনি এসে দিশেহারা জাতিকে মুক্তির অমীয় বাণী শোনালেন, যার মাধ্যমে তাদের সামনে সভ্যতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় এবং ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়ের রচনা হয়; যা ছিল মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ টার্নিং পয়েন্ট। এভাবেই বাঁক পরিবর্তনের সূচনা হয়। শুরু হয় এক নতুন যাত্রা, জয় হয় মানবতার।
১০ হিজরি সালের ৯ জিলহজ আরাফার দিনে জাবালে রহমতের ওপর দাঁড়িয়ে উপস্থিত প্রায় সোয়া লাখ সাহাবির উদ্দেশে এবং পরদিন ১০ জিলহজ ঈদের দিন ও কোরবানির দিন যে ভাষণ দিয়েছেন, সেটি বিশ্বমানবতার মুক্তির শ্রেষ্ঠ সনদ হয়ে থাকবে। মূলত সে ভাষণটি ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তব কর্মসূচি।
বিশ্বমানবতার মুক্তির এমন কোনো দিক নেই, যার দোলা এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি। মূলত বিদায় হজের ভাষণ মহানবী সা:-এর ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। তা ছাড়া, এ ভাষণটি হলো মহানবী সা:-এর ইন্তেকালের পর থেকে কিয়ামত অবধি বিপদসঙ্কুল পৃথিবীর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান।
সমস্যায় জর্জরিত মানবতা বিবর্জিত অশান্ত ও অসভ্য পৃথিবীতে মানবতার শান্তি ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে সেই ১৪০০ বছর আগে। জীবনকে ঢেলে সাজাতে হবে মহানবীর সুমহান আদর্শে।
লেখক : শিক্ষক, আরবি ভাষা ও সাহিত্য
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-