প্রবাসীদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে বেড়েছে প্রাণঘাতী এইডস রোগী

ডেস্ক রিপোর্ট ◑ প্রবাসীদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে বাড়ছে এইচআইভি (এইডস) ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। অসচেতনতায় এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী অনেক প্রবাসী পরিবারের অন্য সদস্যদের আক্রান্ত করছেন।

চলতি বছর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ল্যাবে পরীক্ষায় ৭১ জনের রক্তে এইচআইভি ভাইরাসের নমুনা শনাক্ত হয়েছে। এদের বেশিরভাগ বিদেশফেরত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্য।

চমেকের অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) বিভাগের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে বর্তমানে তালিকাভুক্ত এইডস রোগী ৪২১ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে শনাক্ত হয় ৭১ জন, এদের মধ্যে পুরুষ ৪৪, নারী ১৮ ও শিশু ৯ জন। আক্রান্ত রোগীর মধ্যে নিয়মিত সেবা নেন ৩২৬ জন। এ ছাড়া এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর মারা গেছে ১০ জন।

এর আগে ২০১৮ সালে শনাক্ত হওয়া রোগীর মধ্যে ২৪ পুরুষ, ১৯ নারী ও দুজন হিজড়া ছিলেন। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন। ২০১৭ সালে শনাক্ত রোগীর মধ্যে ছিল পুরুষ ১৯, নারী ১০ ও হিজড়া ১। ওই বছর তিনজন মারা যান।

এ বিষয়ে চমেক হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের মেডিকেল অফিসার ও এআরটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডা. সঞ্জয় প্রসাদ দাশ বলেন, এইডস আক্রান্ত ৩২৬ রোগী দুই মাস অন্তর চিকিৎসাসেবা নেয়। এদের মধ্যে বিদেশফেরত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সংখ্যা বেশি। তবে জনবল সংকটে এইচআইভি বহনকারী রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের এখানে একসময় এইডস রোগীর চিকিৎসা চলাকালে রোগের মাত্রা জানার জন্য সিডি-ফোর সেল কাউন্টিং মেশিন ছিল। যদিও বর্তমানে সিডি-ফোর খুব একটা প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে এইডস রোগীদের সরকার কর্তৃক ওষুধ দেওয়ার ফলে মেশিনটির ওপর নিভর্রতা কমেছে।

চমেক হাসপাতালে প্রিভেনশন ইন মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশনের (পিএমটিসি) দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রোগ্রাম অফিসার আলী হোসেন বলেন, ২০১৩ সাল থেকে ৭৪ হাজার ১০৪ জন গর্ভবতী নারীর এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়েছে এই কর্নার থেকে। ২০১৯ সালে পজেটিভ ১৯ জন নারী। এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে কাউন্সেলিং সেবা নিয়েছে ৭৫ হাজার ২৮৭ জন গর্ভবতী নারী। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় হওয়া এ রোগে আক্রান্তের হার বেশি। এর মধ্যে নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, সাতকানিয়ায় এর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

সিডি-ফোর মেশিন নেই চট্টগ্রামে মরণব্যাধি এইচআইভির (হিউম্যান ইমু¨নোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) মাত্রা নির্ণয়ের মেশিন নেই চমেকে। পাঁচ বছর ধরে সিডি-ফোর সেল কাউন্টিং মেশিন নষ্ট থাকায় চলতি বছরের ফেব্রম্নয়ারি মাসে মেরামতের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হলেও আশার কোনো বার্তা নেই। ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ওষুধ দিয়ে ও টেস্টের মাধ্যমেই এখন এইচআইভি আক্রান্ত সেবা পরিচালিত হচ্ছে।

অকেজো মেশিনের কারণে পরীক্ষার জন্য বারবার ঢাকায় যাওয়ার প্রয়োজন হওয়ায় অনেকেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, অনেকে চিকিৎসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। চমেক হাসপাতালে কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এই পরীক্ষা করা হয়। এআরটি কর্নারে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগী জানান, গত বছর জেনেছি এইডসে আক্রান্ত হয়েছি। এরপর থেকে ওষুধ নিচ্ছি। তবে পরীক্ষা করার জন্য ঢাকা যেতে আসতে অনেক টাকা লাগে। আর সিরিয়াল পেতে সময়ও লাগে বেশি। এই পরীক্ষা যদি চট্টগ্রামে হতো, তাহলে ভোগান্তি কম হতো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ১ জুলাই মেশিনটি চমেকের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে বসানো হয়। এরপর ওই বছর ২৭ সেপ্টেম্বর মেশিনটি নষ্ট হয়। মেরামতের পর তা চালু হলেও ২০১৪ সালে মেশিনটির সফটওয়্যারে সমস্যা দেখা দেয়। এরপর আর চালু করা যায়নি। সিডি-ফোরের মাধ্যমে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ণয় করা যায়। কোনো ব্যক্তির যদি ২০০-৩৫০ এর মধ্যে সিডি-ফোর নেমে আসে, তাহলে তাকে এইডসের ওষুধ দিতে হয়। সিডি-ফোর সেল কাউন্টিং মেশিনের মাধ্যমে এক ধরনের রাসায়নিক (রিএজেন্ট) ব্যবহার করে রোগের মাত্রা নির্ণয় করা হয়।

ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসার বিষয়ে চমেক হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান বিশেষজ্ঞ ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম, ‘এআরভি ড্রাগস সেবনের ফলে এইডস রোগের সংক্রমণ কমে গেছে। এইচআইভি আক্রান্ত রোগীরা এ ওষুধ সেবনের ফলে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকছেন। ওষুধটি এইচআইভির জীবাণু না মারলেও তা নিষ্ক্রিয় করে রাখে। সংক্রমণ ছড়াতে দেয় না।’

তিনি বলেন, এই ভাইরাসটি শুধু যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের হিসাব করেই এইচআইভি আক্রান্ত নির্ধারণ হয়। এর বাইরে অনেকেই আছেন, যারা লোকলজ্জার ভয়ে পরীক্ষা বা চিকিৎসার জন্য আসেন না। গত কয়েক বছরে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির প্রায় ৮০ শতাংশই বিদেশফেরত ও তাদের মাধ্যমেই সংক্রমিত।

জনবল সংকট : এআরটি কর্নার দীর্ঘদিন ধরে জনবল সংকটে ভুগছে। এইডস বিষয়ে নানা সেমিনার কাউন্সেলিং করলেও নেই বিশেষায়িত কোনো কাউন্সিলর পদ। একজন চিকিৎসক দিয়ে চলছে কাজ। নেই পরিসংখ্যান রেকর্ড করার কোনো পদ। তাই সঠিক পরিসংখ্যানও যথা সময়ে পাওয়া যায় না। রোগীদের সেবার জন্য রয়েছে দুজন নার্স। যদিও তারা চর্ম ও যৌন বিভাগ হতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে। স্টোরকিপার না থাকায় চিকিৎসক-নার্স মিলেই এই দায়িত্ব পালন করেন।

আরও খবর