ডেস্ক রিপোর্ট • রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে কূটনীতি নতুন মোড় নিয়েছে। এখন প্রত্যাবাসনের বদলে মিয়ানমারের অপপ্রচার রোহিঙ্গা সংকটে প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার চেয়ে গাম্বিয়ার মামলা এবং আর্জেন্টিনার মানবাধিকার কর্মীদের অন্য একটি মামলার পর মিয়ানমার ব্যাপকভাবে বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচারের কৌশল নিয়েছে। এখন এই অপপ্রচার মোকাবিলায় সঠিক তথ্য তুলে ধরে ব্যাপকভাবে প্রচার চালাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্নিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের অপপ্রচারের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৫ নভেম্বর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির কার্যালয়ের একজন মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে দবি করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সহযোগিতা করেনি এবং দু’দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেনি। ওই মুখপাত্র আন্তর্জাতিক আদালতে রাখাইনে গণহত্যা বিচারের মামলার জন্যও কঠোর সমালোচনা করেন। রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নানামুখী রাজনীতির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও দায়ী করেন তিনি।
সংশ্নিষ্ট একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ওই সংবাদ সম্মেলনের পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এবং পশ্চিমা বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাসে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ অসহযোগিতা করছে, চুক্তির শর্ত মানছে না- এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে নেপিদোতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের মাধ্যমেও বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলার পর মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছে। কারণ হেগের এই আদালত থেকে গণহত্যার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে রায় দিলে তা সব সদস্য রাষ্ট্রকে মানতে হবে। এর ফলে আদালতের রায়ে গণহত্যার জন্য কেউ চিহ্নিত হলে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের রায় হলে, ওই ব্যক্তিরা সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে ভ্রমণ করতে পারবেন না। আইসিজের সদস্য কোনো রাষ্ট্রে ভ্রমণে গেলেই তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির প্রতিবেদনও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। ফলে বিচারের রায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে এ মামলা মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নতুন করে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। আইসিজেতে মামলার জন্য মিয়ানমার বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতাকেই দায়ী করছে। এ অবস্থায় সংকট সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতেই মিয়ানমার পুরোদমে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারে মেতে উঠেছে।
সংশ্নিষ্ট অন্য একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, এ ধরনের অপপ্রচার মিয়ানমারের জন্য খুব বেশি লাভজনক হবে না। কারণ রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনী কী ধরনের গণহত্যা চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করতে কী ধরনের অপকৌশল নিয়েছে, সেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্পষ্ট। তবুও মিয়ানমারের এ ধরনের অপপ্রচার বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মিয়ানমারের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক ব্রিফিং এবং সৌজন্য বৈঠকের মাধ্যমে মিয়ানমারের অপপ্রচারের জবাব তুলে ধরা হয়েছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া অপপ্রচার মোকাবেলায় রোহিঙ্গা সংকটের বর্তমান অবস্থার সঠিক চিত্র তুলে ধরে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের কাছে প্রচার চালানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, মিয়ানমারের অপপ্রচারের কারণেই বরং রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হচ্ছে এবং প্রত্যাবাসনও বিলম্বিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার পরিবর্তে এখন অপপ্রচার মোকাবেলার কূটনীতিতেই জোর দিতে হচ্ছে বেশি। তবে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর বর্তমানে মিয়ানমার সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে বলেও জানায় সূত্র।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদ: গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মিয়ানমারের অপপ্রচারের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এতে বলা হয়, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, রাখাইনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক জাতিগত নিষ্ঠুর নির্মূল প্রক্রিয়া চলেছে। মিয়ানমারের বর্তমান সরকারও তারই ধারাবাহিকতায় সংকটকে আরও চরম মাত্রায় নিয়ে গেছে। মূলত রোহিঙ্গা সংকটের উৎস মিয়ানমার এবং সমাধানও মিয়ানমারকেই করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার জন্য মিয়ানমারই একমাত্র দায়ী। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা ইচ্ছা নেই। বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব সময়ই পূর্ণ প্রস্তুতি ও সহযোগিতার হাত নিয়ে বসে রয়েছে এবং সেটা কাজেও প্রমাণ দিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত আগস্ট মাসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই রোহিঙ্গারা জানায়, রাখাইনে তাদের স্থায়ী বসবাসের নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ফিরে যাবে না। রাখাইনে নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তা সৃস্টির দায়িত্ব মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। অতএব আগস্ট মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে বার বার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে ও নিরাপদে নাগরিক অধিকারসহ বসবাসের নিশ্চয়তা সৃষ্টির অনুরোধ জানানো হলেও মিয়ানমার সে ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমার এর আগে রাখাইনে বার বার নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানালেও তা সত্য প্রমাণিত হয়নি। অতি সম্প্রতি রেডিও ফ্রি এশিয়ার একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃস্টি হয়নি, বরং সেখানে এখনও ভীতির পরিবেশ জিইয়ে রাখা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কক্সবাজারে ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা বিদ্রোহী আরসার ভয়ে এবং এনজিও কর্মীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সঠিক মনোভাব প্রকাশ করছে না বলে মিয়ানমার যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মিয়ানমারের কর্মকর্তারাই ক্যাম্প পরিদর্শন করে এ ধরনের কোন ঘটনা দেখেননি বলে জানিয়েছেন। কোনো পক্ষ থেকেই রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফিরতে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে না।
বিজ্ঞপ্তিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে সব ধরনের অপপ্রচার ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-