কক্সবাজার জেলায় আমন ধানে রোগের আক্রমন: আতংকে কৃষক!

শাহীন মাহমুদ রাসেল •

কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে আমন ধানে ‘নেক ব্লাষ্ট’সহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ধানে লাল রঙ ধারণ করে চিটায় পরিণত ও পাতা জ্বলসে যাচ্ছে। ফলে আক্রান্ত জমির কৃষক ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। এতে আর্থিক লোকসানে পড়তে হচ্ছে কৃষককে।

সদর উপজেলার ঝিলংজা ও পিএমখালীর কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, জমিতে ধানে পাঁক ধরেছে। দুর থেকে ধানের পাঁকা রঙ দেখে মনে হবে এই বুঝি ধান ঘরে তোলার সময় হলো। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি গোঁচার ধান চিটায় পরিণত হয়েছে।

পিএমখালী ইউনিয়নের পাতলী গ্রামের কৃষক মৌলভী ওসি (৫৫) বলেন, গত ৪-৫ দিন ধরে হঠাৎ তার জমির ধান লাল রঙ ধারণ করে। জমিতে গিয়ে দেখেন, ধানগুলো সব চিটায় পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থা দেখতে পেয়ে তিনি দিশেহারা। এ মুহুর্তে কোনো ঔষধও কাজ করবে না। কোনো উপান্তর না পেয়ে হতাশা নিয়ে শুধু জমিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে।

তিনি বলেন, শ্রবণ মাসের দিকে তিনি বাড়ির পাশের ৫০ শতাংশ জমিতে হাইব্রিট হিরা-২ আবাদ করেন। বীজ, মজুরি ও সার মিলিয়ে তাঁর প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ধান গাছগুলো ছিল নাদুস-নদুস। দেখতে বেশ সুন্দর। গাছে ধানের থোড়গুলো দেখার মতো। সে হিসেবে আশা করেছেন অন্তত ৭৫-৭৮ মণ ধান পাবেন। যা অগ্রহায়ণের ৫-৭ তারিখের মধ্যে কেটে ঘরে তুলতে পারবেন। কিন্তু হঠাৎ জমির ধান এক সঙ্গে লাল হয়ে চিটায় পরিণত হয়েছে। ধার-কর্জ করে অন্যের জমিতে বর্গা করেছেন এ বছর। কিন্তু এখন এক মুঠো ধানও ঘরে তোলা যাবে না।

কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা পিকেএসএফ এর অর্থায়নে দুই একর জমিতে উচ্চ ফলনশীল ব্রি-৬৭ ধানের প্রদর্শনী করেছেন। বেশ ভালোভাবেই গোচাগুলো গজিয়েছে। কিন্তু শেষের দিকে দেখতে পান এক সঙ্গে জমির প্রায় সব ধান লাল হয়ে চিটায় পরিণত হয়েছে। এক প্রশ্নে তারা বলেন, বেশ কয়েকটি জমিতে থোড় আসার সঙ্গে সঙ্গে স্প্রে করা হয়েছে। যেগুলোতে স্প্রে করা হয়েছে সেগুলোতে এ রোগ দেখা দেয়নি। হঠাৎ এ রোগ দেখা দেবে এমনটা তারা বুঝেও উঠতে পারেননি। এখন দেখা গেছে দুই একর জমির ধান না পাওয়ার আশংকা বেশি।

তাদের মতে, সদরে এ বছর আমন ধানের আবাদ হয়েছে বেশি। এর মধ্যে হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল জাতের ধানই বেশি আবাদ হয়। আর যে রোগ দেখা দিয়েছে তা এসিআই, হিরা-২ ও উচ্চফলনশীল ব্রি-৬৭ জাতের মধ্যে বেশি দেখা দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু সদর উপজেলায় নয়। এ সমস্যা দেখা দিয়েছে রামু ও উখিয়ার বিভিন্ন আমন ধানে। ফলে আক্রান্ত জমির কৃষকরা মাতায় হাত দেয়ার উপক্রম হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধানে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে- তাহচেছ গাছ ঠিক আছে শুধু ধান চিটা। চিটার যে লক্ষণ দেখা দিয়েছে তা রোগের কারণে যেমন হতে পারে, তেমনি নকল বীজের কারণেও হতে পারে। রোগের মধ্যে নেক ব্লাষ্ট, কোল্ড ইঞ্জুরি ও মাজরা আক্রম অন্যতম। এ তিনটি রোগে দেখা দেয়ার পেছনে মানহীন বীজ আবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি সমস্যাও কারণ হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিনে অতিরিক্ত গরম ও রাতে নিন্ম তাপমাত্রা দেখা দেয়। এতে কোল্ড ইঞ্জুরি ও নেক ব্লাষ্ট দেখা দিতে পারে।

এছাড়া বীজের মাধ্যমেও এ রোগ ছড়ায়। কৃষক বীজ ক্রয়ের পর বীজ শোধন করলে বীজবাহী রোগ দেখা দেবে না। আবার বীজ বিক্রেতারা অতিরিক্ত লাভবান হওয়ার কারণে নকল বীজ বাজারজাত করছে। নকল বীজে ধান আসলেও তা চিটায় পরিণত হবে। এসব মিলিয়েই ধানে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা। তবে ধান গাছের পেটে থোড় আসার সঙ্গে সঙ্গে যদি কৃষক কৃষিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী ধানে স্প্রে করে তাহলে ‘নেক ব্লাস্ট’, ‘মাজরা’ ও ‘কোল্ড ইঞ্জুরি’ থেকে মুক্তি পেতে পারে। এর বাহিরে নকল বীজের কারণে যে সমস্যা হচ্ছে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে বীজ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে মনে করেন বিষেজ্ঞরা।

এ বিষয়ে কৃষি গবেষণা ইনিষ্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ধানে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা শুধু নেক ব্লাস্ট বললে হবে না। একেক জমিতে একেক কারণে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোথাও নেক ব্লাষ্ট, কোথাও কোল্ড ইঞ্জুরি, আবার কোথাও মাজরার আক্রমন। এছাড়া অনেক ক্ষেতে নকল বীজের কারণেও ধান চিটা হয়েছে। তাঁর দৃষ্টিতে সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরিক্ষা না করে রোগ বা সমস্যার কথা বলা মসুকিল। কক্সবাজারে তাৎক্ষণিক রোগ নির্ণয়ের জন্য কোনো পরীক্ষা-নিরিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলায় এ বছর আমন ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি মৌসুমে আমন আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮২ হাজার ১১২ হেক্টর। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৭৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে। যা গত বছরের তুলনায় ৮ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমি বেশি আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সদরে ৯ হাজারর ৫০, রামু ৯ হাজার ৪৫০, চকরিয়া ১৯ হাজার ৪৪০, পেকুয়া ৮ হাজার ৪০০, উখিয়া ৯ হাজার ৬১০, টেকনাফ ১০ হাজার ৭৬০, মহেশখালী ৮ হাজার ২৪০ ও কুতুবদিয়া ৪ হাজারর হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়। আবাদ অনুযায়ী এ বছর ২ লাখ ৩০ হাজার ৪৬২ টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা। তবে উখিয়ার কিছু কিছু স্থানে ‘নেক ব্লাষ্ট’ দেখা দেয়ায় উৎপাদন কিছুটা কম হবে।

তবে কথা হয়েছে কক্সবাজার কৃষি অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শামশুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, বীজের কারণে ধান চিটা হওয়ার সম্ভাব থাকে। তবে চলতি মৌসুমে কোথাও নকল বীজের বিষয়টি তাঁর দৃষ্টিতে আসেনি। তারপরও বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। যদি নকল বীজের কারনে চিটা দেখা দেয় তাহলে অবশ্যই বিক্রেতা ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, যতটুকু শুনেছেন ধানে ‘নেক ব্লাষ্ট’ নামক রোগ দেখা দিয়েছে। যে জমিনে এ রোগ দেখা দিয়েছে সে জমিনের সব ধানই চিটায় পরিণত হয়েছে।

আরও খবর