আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। বড় হয়ে একদিন তারাই দেশের হাল ধরবে। এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে।
তবে শিশুর মানসিকতাকে সেভাবে গড়ে তোলা জরুরি। শিশুর মানসিকতা গঠনে দু’জায়গার ভূমিকা থাকতে হবে। এক হচ্ছে পরিবারের শিক্ষা। পরিবার থেকে যা শিখে, একটি শিশু সে অনুযায়ীই চলার চেষ্টা করে এবং অন্যকে চালাতে চায়। তাই পরিবারের মূখ্য ভূমিকা থাকতে হবে শিশুর সুস্থ মানসিকতা গঠন ও মানবিকতার বিকাশে। দ্বিতীয় স্থল হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখান থেকেও শিশুর মানসিকতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। একজন আদর্শ শিক্ষকের নির্দেশনা, যে কোনো ছাত্রের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। মানবীয় গুণাবলীর বিকাশে শিক্ষকদেরই মেহনত করতে হবে। এক্ষেত্রে বই, পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতাই মূল হওয়ায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়মিত যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়েছে। যেখানে শিশুর মানসিকতা গঠন ও মানবীয় গুণাবলীর বিকাশের কোনো ফুরসত নেই। বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করছেন।
আপনাদের সামনে সূরা লুকমানের কয়েকটি আয়াত তুলে ধরবো। সেখান যা জানতে পারবো, শিশুর মানসিকতা গঠনের জন্য তা সহায়ক হবে, ইনশাল্লাহ! মানসিকতা গঠনের জন্য সন্তানের সঙ্গে ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত, মানবিকতার মূল উৎস কী, শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলো লক্ষণীয় ইত্যাদি।
শিখাতে হবে স্নেহ ও নমনীয়তার সঙ্গে:
ইবনে খালদুনের মুকাদ্দামা ও আল কোরআনের সূরা লুকমানের আয়াত, যেখানে সন্তানকে পিতার শিক্ষা দেয়ার বিবরণ এসেছে তা থেকে জানা যায়, কঠোরতার চেয়ে স্নেহের সঙ্গে ও ভদ্রভাবে বুঝানোর দ্বারা সন্তানরা শিখতে আগ্রহী হয়। প্রথমে সূরা লুকমানের ওই আয়াত থেকে বিষয়টি জেনে নেয়া যাক। আল কোরআনের বাণী ‘(স্মরণ করুন) যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘হে আমার বৎস! আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো না, নিশ্চয় শিরক করা ভয়াবহ জুলুম।’ বাংলা ভাষায় ‘বৎস’ শব্দটি ‘ছেলে’র তুলনায় আদর, স্নেহ বেশি বুঝায়। স্নেহের ছেলে বুঝাতেই ‘বৎস’ শব্দটি ব্যবহার হয়। যেমনটি আরবি ভাষায় ‘বুনাইয়া’ শব্দ ‘ইবনুন’এর তুলনায় কিছুটা আদরের। আদরের ছেলে বুঝানোর জন্য বলা হয় ‘বুনাইয়া’। এখানে ভাষার ব্যবহার দেখানোর দ্বারা উদ্দেশ হচ্ছে, লুকমান হাকিম নিজ পুত্রকে ‘ছেলে’ না বলে, ‘বৎস’ বলে সম্বোধন করেছেন। কারণ, স্নেহের সঙ্গে তাকে কথা গুলো বলা হলে সে শুনবে এবং মেনে চলবে।
শাসনের দু’রকম পদ্ধতিই আমাদের সমাজে প্রচলন আছে। কেউ আছেন, বকা দিয়ে, মারপিট ও রাগ দেখিয়ে সন্তানকে মানুষ করতে চান। আবার অনেকে আদর সোহাগ দিয়ে, নরম ভাষায় বুঝিয়ে সন্তানকে ভালো মানুষ বানাতে চান। দ্বিতীয় পদ্ধতিটাই বেশি কার্যকর। এ বিষয়টি ইবনে খালদুন তার মুকাদ্দামায় আলোচনা করেছেন, ‘যে শিক্ষক কঠিন শাসনের মাধ্যমে ছাত্রকে মানুষ বানাতে চায়, ভবিষ্যতে ওই ছাত্র ধোঁকা দেয়ার কৌশল গ্রহণ করে। দূরে দূরে থাকে। কারণ, মূল বিষয় শিক্ষককে বললে তার রোষানলে পড়তে হতে পারে। একজন অবুঝ ছাত্রের কাছে, এর চেয়ে মিথ্যা বলে দেয়াই শ্রেয়।’ এ বিষয়ে ইবনে খালদুনের পুরো চিন্তা পৃথক একটা লেখায় আলোচনা হবে-ইনশাআল্লাহ!
সন্তানকে দ্বীনদারি শিখালে অমানবিক আচরণ থেকে পিতা-মাতা রক্ষা পায়:
পূর্বোক্ত আয়াতে আলোচনা হয়েছে, লুকমান (আ.) পুত্রকে শিরক না করার উপদেশ দিয়েছিলেন। এর পরের আয়াতেই আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ জারি করলেন, ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার ব্যাপারে তাগিদ দিচ্ছি, (তারা যেন পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর)।’ উক্ত দুই আয়াত সম্পর্কে মুফাস্সিরগণের অভিমত হচ্ছে যে, এর দ্বারা প্রতীয়মাণ হয়, মানুষ যদি তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সৃষ্টিকর্তার হক সম্পর্কে সচেতন করে তাহলে আল্লাহ তায়ালাও সন্তানদের মনকে পিতা-মাতার হক রক্ষার জন্য প্রস্তুত করে দেবেন। সে সন্তান কখনো পিতা-মাতার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করবে না। কেমন যেন কোরাআনের ভাষ্য হচ্ছে এমন ‘মানুষ যদি সন্তানদের মনে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের শিক্ষা দিয়ে দেয় তাহলে আল্লাহ তায়ালাও সন্তানদের মনে পিতা-মাতার সম্মান ও ভালোবাসা বসিয়ে দেবেন। ফলশ্রুতিতে, সন্তান সর্বদা পিতা-মাতার অনুগত হয়ে চলবে।’
আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত মানুষ সন্তানের অবাধ্যতায় হার মেনে, তাবলিগে পাঠায় যে, সেখানে কিছু দিন সময় দিলে পরিবর্তন আসতে পারে। বাস্তবে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছেও। এই শিক্ষাটাই যদি সময় মতো দেয়া হতো তাহলে হয়তো সকলের জন্য জীবনটা আনেক আসানের হতো। তাই সন্তানকে যে শিক্ষাই দেয়া হোক, এর সঙ্গে দ্বীনদারির শিক্ষাও যেন থাকে।
অন্যায়ের সামনে আপোষহীনতার শিক্ষা:
জীবনের পরিসরকে অনেক ছোটো করে ফেলা হয়েছে। ক্ষুদ্র স্বার্থের পেছনে সন্তানকে দৌঁড়তে শিখাচ্ছি। মানবতা ভুলণ্ঠিত হলে, সমাজে অন্যায়, অবিচার হলে তা প্রতিকারের শিক্ষা আমরা দিচ্ছি না। আমাদের মনোভাব হচ্ছে, সমাজের অধ:পতন, নৈতিকতার অবক্ষয় ও মূল্যবোধের ঘাটতির সামনে আপোষকামিতাকে উত্তম। এক্ষেত্রে সন্তানের মানসিকতা গঠন করতে হবে, অন্যায় যেই করুক তা মেনে নেয়া যাবে না। সামর্থ্য থাকলে প্রতিবাদ করতে হবে। পিতা-মাতাও যদি অন্যায় করে তাহলে এটাকে নিজের করণীয় হিসেবে ঠিক করা যাবে না। তারা অন্যায় করতে চাপ দিলে, অন্যায় করা যাবে না। অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে মূল্যায়ন করতে শিখাতে হবে। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে ‘আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি করে, মানুষের আনুগত্য করা যাবে না (সে যে কেউ হোক না কেন)।’ (সহীহ বোখারী)।
এ বিষয়ে, সন্তানের মানসিকতা গঠন সম্পর্কে আল কোরআনে বলা হয়েছে ‘আর যদি পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয়, এমন বস্তুকে আমার শরীক সাব্যস্ত করতে, যার সম্পর্কে তোমার জানা নেই তাহলে তাদের কথা মানবে না।’ তবে এ-নিয়ে পিতা-মাতার সঙ্গে খারাপ আচরণও করা যাবে না। দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে সদভাব বজায় রেখে চলতে হবে। আর অনুসরণ করতে হবে আদর্শবান মানুষকে।
সামাজিকতার শিক্ষা:
সন্তানের শিক্ষা বলতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা পড়ানো হয়, তার মাঝেই কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও সন্তানকে অনেক কিছু শেখাতে হয়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে সামাজিকতা শেখানো। মানুষের সামনে কীভাবে কথা বলতে হবে, রাস্তা দিয়ে চলার সময় কোন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, বড়দের সামনে, বৈঠকে কীভাবে বসতে হবে ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে সন্তান ভালো ছাত্র হলেই, সামাজিকতাও ভালো বুঝবে তেমন কিন্তু নয়। সামাজিকতা চর্চার বিষয়। মানুষের সামনে গেলে নিজের ভুলগুলো ধরা পড়বে। প্রথম প্রথম তা শুধরানোর দায়িত্ব কিন্তু পিতা-মাতার ওপর। ইসলাম নামাজ, রোজার ন্যায় সামাজিকতাকেও অনেক গুরুত্ব দিয়েছে।
পবিত্র আল কোরআনে সন্তানদের সামাজিকতা শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এভাবে ‘(স্মরণ করুন ওই সময়ের কথা যখন লুকমান তার ছেলেকে বলেছিল) কথা বলার সময় মানুষের দিক থেকে চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে রেখো না এবং পৃথিবীতে দম্ভ করে চলো না। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা, দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না। আর তুমি চলাফেরায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর এবং কথা বলার সময় কণ্ঠস্বর নিচু রাখ। নিশ্চয় সবচেয়ে অপ্রীতিকর আওয়াজ, গাধার আওয়াজ।’
উল্লিখিত আয়াতে অনেকগুলো বিষয়ের আলোচনা হয়েছে। প্রথম বলা হয়েছে, কথা বলার সময় শ্রোতাদের থেকে চেহারা অন্যদিকে না ফেরাতে। কারণ এর দ্বারা শ্রোতাদের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য প্রকাশ পায়। তাই কথা বলার সময় এমন কোনো শব্দ বা আচরণ না করা যা দিয়ে উক্ত বিষয় ফুটে ওঠে। সন্তানকে নিরহংকারী হিসেবে গঠন করতে হবে। অহংকার পতনের মূল। অহংকারী দ্বারা সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলাই শুধু জন্ম নেয়। বড়দের অমান্য করা, নিজের মন মতো চলতে কোনো বাধা আসলে জিদ ধরা অহংকারের আলামত। তাই সন্তানের মনে অহংকার যেন বাসা না বাঁধে সে ব্যাপারে সজাগ থাকা। কথা উঁচু আওয়াজে বলাটাকে অনেকে বেটাগিরি মনে করে, কিন্তু এটা সামাজিকতার পরিপন্থি। তাই নম্র ভাষায়, নিচু আওয়াজে কথা বলা শেখাতে হবে।
সন্তানকে গড়তে হবে মানুষের হক ও অধিকার রক্ষায় যতত্নবান হিসেবে:
ইসলামের নির্দেশনার দিকে তাকালে, একজন মানুষের কাছে দু’ধরনের অধিকার সংরক্ষিত থাকে। আল্লাহ তায়ালার অধিকার ও বান্দার অধিকার। অধিকারকে হক শব্দ দিয়েও ব্যক্ত করা যায়। আল্লাহ তায়ালার হক হচ্ছে, তার বিধিবিধান যথাযথভাবে আদায় করা। বান্দার হক হলো, আল্লাহ তায়ালা, একজন মানুষের ওপর, অন্য একজন মানুষের হক হিসেবে যেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তা আদায় করা। বান্দার ওপর বান্দার হক কোনো দ্বীনি বিষয় হতে পারে আবার হতে পারে কোনো জাগতিক বিষয়। হক নষ্ট করা যে কতো বড় অন্যায় তা বুঝা যায় এক হাদিসের দ্বারা। সেখানে বলা হয়েছে, হাশরের ময়দানে কোনো কোনো বান্দা অনেক নেক আমল নিয়ে উঠবে। কিন্তু সে দুনিয়াতে মানুষের হক নষ্ট করেছে। তাই তার নেক আমল দ্বারা ওই বান্দার হক পরিশোধ করা হবে। এক পর্যায়ে নেক আমল ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু মানুষের হক তার ওপর থেকে যাবে। তখন মানুষের গোনাহ দিয়ে তাকে চাপা দেয়া হবে। এভাবে আখেরাতে সে শাস্তি ভোগ করবে। তাই সন্তানদেরকে মানুষের হকের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।
মানুষের অধিকারের ব্যাপারে যত্নশীল করে গড়ে তুলতে হবে। সন্তানকে এ ব্যাপারে শিক্ষা দেয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘( হে বৎস!) নামাজ কায়েম কর, মানুষকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ কর এবং এক্ষেত্রে যে প্রতিকূলতা আসবে ধৈর্যের সঙ্গে তার মোকাবিলা কর। নিশ্চয় তা উঁচু হিম্মতওয়ালাদের কাজ।’ এখানে সন্তানকে আল্লাহ তায়ালার হক তথা নামাজের ব্যাপারে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এরপর সন্তানকে শিখানো হয়েছে, মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে ফেরানো ও ভালো কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়। এটাও মূলত একজন মানুষের ওপর অন্যদের হক। অন্যায়কারীকে অন্যায় থেকে ফিরিয়ে ভালো পথে পরিচালিত করা, ভালো মানুষের ওপর অন্যায়কারীর হক। তাই ইসলামে, সন্তানের মানসিকতা গঠনের এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক যে, সন্তানকে মানুষের অধিকারের ব্যাপারেও সচেতন করা।
পিতা-মাতা হওয়ার আগে, পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য কী, তা জেনে নেয়া দরকার। সন্তান শুধু জন্ম দেয়াই পিতা-মাতার কাজ নয় বরং তাকে সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাও তাদেরই কাজ। এ জন্য আগে পিতা-মাতার নিজেদের সংশোধন হতে হবে। পিতা-মাতার আচার-ব্যবহার দেখে সন্তান শিখবে। তাই স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। সন্তানের সামনে কখনো ঝগড়া, গালিগালাজ করবে না। বড়দেরকে সম্মান করা, ছোটদেরকে স্নেহ করা, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার, সামাজিকতা পিতা-মাতা থেকে সন্তান শিখে। তাই এগুলোতেও আগে পিতা-মাতার আদর্শ স্থাপন করতে হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-