আজিম নিহাদ •
রোহিঙ্গা শিবিরে বিতর্কিত এনজিও রিসডা বাংলাদেশের চলমান ‘এডুকেশন প্রকল্পে’ প্রতিটি লার্নিং সেন্টার নির্মাণের বরাদ্দ ছিল ২ লাখ টাকা। কিন্তু তার অর্ধেকও খরচ করেনি। মাত্র ৯০ হাজার টাকা খরচ করেই সেন্টার নির্মাণের দায় সেরেছে সংস্থাটি। দাতা সংস্থার নির্ধারিত সিডিউল অনুযায়ী লার্নিং সেন্টারগুলোতে যেসব সুবিধা থাকার কথা সেসবের কিছুই নেই। একারণে নির্মাণের প্রায় কয়েক মাসের মাথায় বাতাসের হাল্কা গতিতে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল অধিকাংশ সেন্টার।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, শুধুমাত্র ১৫০টি লার্নিং সেন্টার নির্মাণ থেকেই দুই কোটির টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে এনজিও সংস্থা রিসডা বাংলাদেশ। একই প্রকল্পের অন্যান্য খাত থেকে আরও কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে সংস্থাটির বেশকিছু দুর্নীতির প্রমাণ দাতা সংস্থাও পেয়েছে। যা নিয়ে বর্তমানে তুলকালাম চলছে।
শুধু প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি নয়, দেশবিরোধী বিভিন্ন কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করারও নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে রিসডা বাংলাদেশ। একাত্তরের ঘৃন্য যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার হাতে রিসডা বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। তবে বর্তমানে এই এনজিও’র নেতৃত্ব দিচ্ছেন হেমায়েত হোসেন নামে এক সময়ের শিবির ক্যাডার।
সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ঢলের আগে রিসডা বাংলাদেশ ছিল নাম স্বর্বস্ব একটি সংস্থা। কিন্তু হঠাৎ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা ঢল আসা শুরু হওয়ায় রিসডার কপাল খুলে যায়। তুরস্কের জামায়াতি কানেকশন থেকে অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার ফান্ড আসতে শুরু করে কাদের মোল্লার এনজিওতে। হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যায় সংস্থাটি। শক্তপোক্ত হওয়ায় জাতিসংঘের দাতা সংস্থাগুলোর দিকেও উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে রিসডা। কতিপয় কিছু ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এডুকেশন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ রিডসা বাংলাদেশকে দায়িত্ব দেয়। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে রোহিঙ্গা শিবিরে এডুকেশন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য ইউনিসেফের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় রিসডা। এক বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের বাজেট ১৯ কোটি টাকা।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এডুকেশন প্রকল্পে দুই ধাপে রোহিঙ্গা শিবিরে ১৫০টি লার্নিং সেন্টার নির্মাণের শর্ত ছিল। প্রকল্পের শুরুতেই লার্নিং সেন্টার নির্মাণে ভয়াবহ দুর্নীতি শুরু করে রিসডা বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক হেমায়েত হোসেন। প্রতিটি লার্নিং সেন্টার নির্মাণে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও মাত্র ৯০ হাজার টাকা খরচ করে যেনতেন ভাবে লার্নিং সেন্টারগুলো নির্মাণ করে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৩ কোটি টাকার বাজেটের মাত্র ৯০ লাখ টাকা খরচ করে লার্নিং সেন্টার নির্মাণের ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লার্নিং সেন্টার নির্মাণের জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কোন প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করার নিয়ম থাকলেও কোন ধরণের টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই ‘এসএল রিনোএবল এনার্জি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে দেয় রিসডার নির্বাহী পরিচালক। স্থানীয় অদক্ষ কারিগর দিয়ে কম দামের জিনিসপত্র ব্যবহার করে সেন্টারগুলো নির্মাণ করে এসএল রিনোএবল এনার্জি নামের প্রতিষ্ঠানটি।
এসএল রিনোএবল এনার্জি নামের প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স রিসডা বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক হেমায়েত হোসেনের স্ত্রীর নামে। স্ত্রীর নামে ভূয়া প্রতিষ্ঠান খুলে সেন্টার নির্মাণের নামে প্রকল্পের দুই কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেন তিনি। সেন্টার নির্মাণের ভয়াবহ দুর্নীতিতে হেমায়েত হোসেনের সহযোগী হিসেবে কাজ করে এডুকেশন প্রজক্টের সাবেক কো-অডিনেটর মাসুম বিল্লাহ (বর্তমানে ঢাকা হেড অফিসে সংযুক্ত) ও বর্তমান কো-অর্ডিনেটর আব্দুল গাফ্ফার।
এদিকে গেল রমজানের ঈদের আগে বৃষ্টিতে অধিকাংশ লার্নিং সেন্টারের ছাউনি, বেড়া ও মেঝে নষ্ট হয়। এসময় প্রকল্প অফিস থেকে পূণরায় মেরামতের জন্য ইউনিসেফের কক্সবাজার অফিসে লার্নিং সেন্টারগুলোর নাম ও ক্যাম্প উল্লেখ করে একটি রিপেয়ারিং বাজেট দেয় রিসডা। কিন্তু সেন্টারগুলোর নির্মাণকাল ৩ থেকে ৪ মাসের বেশি হয়নি দেখে ইউনিসেফের কর্মকর্তাসহ তাদের ইঞ্চিনিয়াররা বার বার লার্নিং সেন্টারগুলো পরিদর্শন করে। একাধিকবার পরিদর্শনের পর প্রমাণ হয় যে, লার্নিং সেন্টারগুলোর গুণগত মান খুবই খারাপ। প্রাক্কলিত বাজেট ও ডিজাইন অনুযায়ী কনস্ট্রাকশনের কাজ হয়নি। পরে জরুরি তলবে ইউনিসেফের সাথে বৈঠক করে রিসডার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ওই বৈঠকে রিসডা তাদের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে লার্নিং সেন্টারগুলো মেরামত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই সেন্টারগুলো মেরামত কাজ বাস্তবায়ন হয়নি।
রিসডার কক্সবাজার প্রকল্প কার্যালয়ে কর্মরত এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাহী পরিচালক হেমায়েত হোসেন নিজের স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠান খুলে লার্নিং সেন্টার নির্মাণের কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন। নি¤œমানের জিনিসপত্র ব্যবহার করে লার্নিং সেন্টার নির্মাণ করার বিষয়টি দাতা সংস্থার তদন্তেও ধরা পড়েছে। কিন্তু তারপরও কোন পদক্ষেপ নেয়নি ইউনিসেফ। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। জাতিসংঘের একটি সংস্থা কিভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়?
এদিকে লার্নিং সেন্টারের দুর্নীতির পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনে ভাগ বসানোর দুর্নীতির খবরও ফাঁস হয়ে যায়। দুর্নীতির খবর ফাঁস করার পেছনে কিছু কর্মকর্তাদের হাত আছে মনে করে তাদেরকে অনৈতিকভাবে ছাঁটাইও করেছে রিসডার নির্বাহী পরিচালক হেমায়েত হোসেন।
জানা গেছে, ১৯ কোটি টাকার এডুকেশন প্রকল্পের প্রতিটি খাতে বেপরোয়াভাবে দুর্নীতি করেছে রিসডার নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে একটি চক্র। এডুকেশন প্রকল্পে নিয়োগ দেওয়া ১৪ জনের বেতন থেকে প্রতি মাসে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা করে অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয় নির্বাহী পরিচালক। প্রতিমাসে বেতন উত্তোলনের পর ফোকাল পার্সন ৩০ হাজার, কর্মসূচি সমন্বয়ক ২০ হাজার টাকা, প্রতিজন টেকনিক্যাল অফিসার ১৫ হাজার, ইঞ্জিনিয়ার ১০ হাজার টাকা, মনিটরিং অফিসার ১০ হাজার টাকা, প্রতিজন সাপোর্ট স্টাফ ৬ হাজার, অফিস সহকারী ও এডমিন অফিসারকে ৫ হাজার টাকা করে ভাউচারের মাধ্যমে নির্বাহী পরিচালকের একাউন্টে জমা দিতে হয়।
টানা কয়েক মাস অনৈতিক এই দাবী মানলেও এক পর্যায়ে প্রতিবাদ করায় সংস্থা থেকে ৬ জনকে চাকরিচ্যূত করে। তারা হলেন- ফোকাল পার্সন শওকত আলী, ইঞ্জিনিয়ার শরিফুল, টেকনিক্যাল অফিসার নাসিরুদ্দিন, তারিকুল ইসলাম ও আলাউল ও প্রোগ্রাম অর্গানাইজার বুলবুল আক্তার।
রিসডার সাবেক ফোকাল পার্সন শওকত আলী জানান, রিসডার নির্বাহী পরিচালক হেমায়েত হোসেন প্রতিমাসে কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতনের নির্ধারিত একটি অংশ নিয়ে নিত। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় আমাদেরকে চাকরিচ্যূত করেছে। বিষয়টি আমরা দাতা সংস্থাকেও জানিয়েছি কিন্তু তারাও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা ফিরিয়ে পেতে চায়।
তিনি আরও বলেন, প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর আব্দুল গাফ্ফার নির্বাহী পরিচালকের হয়ে সকল দুর্নীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। পুরো প্রজেক্টে এমন কোন খাত নেই যেখানে পুকুর চুরির মত দুর্নীতি হয়নি। অনেকগুলো দুর্নীতির প্রমাণ দাতা সংস্থা ইউনিসেফও পেয়েছে। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
সাবেক প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার শরিফুল ইসলাম বলেন, রিসডাতে তাঁর বেতন ছিল ৬০ হাজার টাকা। ওই বেতন ব্যাংকে পরিশোধ করলেও পরে ১০ হাজার টাকা ক্যাশে রিসডার একাউন্টে জমা দিতে হতো। আমার মত প্রত্যেকের কাছ থেকে বেতনের কমিশন নিয়ে নিতো।
তিনি আরও বলেন, কোটি কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন করলেও কোন ধরণের ভ্যাট পরিশোধ করেনি রিসডা। এরফলে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করেছে। কিন্তু ভূয়া ভ্যাট ভাউচার করে দাতা সংস্থাকে ধোঁকা দেওয়া হয়।
শরিফুল ইসলাম বলেন, এসএল রিনোএবল নামে যে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রিসডার লার্নিং সেন্টার নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করে সেই প্রতিষ্ঠানটির মালিক নির্বাহী পরিচালকের স্ত্রী। এটি মূলত নাম স্বর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের নামেই কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। দাতা সংস্থা তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
এদিকে গত মে মাসে দাতা সংস্থা থেকে স্পট চেক/ অডিট হওয়ার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে বিভিন্নখাতে প্রকল্পের ভূয়া বিল করে দুই কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে টাকার বিনিময়ে ভূয়া বিল ভাউচার সংগ্রহ করে নির্বাহী পরিচালকের দুর্নীতির সহযোগী এডমিন ও লজিস্টিক অফিসার মো. মামুন হোসেন।
অভিযোগের বিষয়ে এডুকেশন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল গাফ্ফার বলেন, লার্নিং সেন্টার নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। কারণ ৯০ হাজার টাকায় একটি লার্নিং সেন্টার নির্মাণ সম্ভব নয়। এছাড়া কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন থেকে কমিশন কেটে নেওয়ার অভিযোগটিও সত্য নয়। এটি অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
রিসডা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হয়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত কাদের মোল্লার কিনা জানতে চাইলে আব্দুল গাফ্ফার আরও বলেন, কাদের মোল্লার সাথে রিসডার কোন সম্পর্ক ছিলনা। তিনি (কাদের মোল্লা) রিসডার প্রতিষ্ঠাতা নই। সম্প্রতি এই অভিযোগটি উঠায় উখিয়ার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমাদেরকে ডেকেছিলেন। তাঁর (ইউএনও) কাছে সকল ডকুমেন্ট দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য রিসডা বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক হেমায়েত হোসেনের মুঠোফোনে সোমবার দুপুরে যোগাযোগ করা হয়। তিনি মুঠোফোন রিসিভ করলেও অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
কাদের মোল্লার মত যুদ্ধাপরাধীর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান রিসডা বাংলাদেশে ইউনিসেফ অর্থায়ন করায় রীতিমত অবাক সচেতন মহল। কারণ রোহিঙ্গা শিবিরে অপমিশন বাস্তবায়নে নিমজ্জিত সংগঠনটি। তাই দ্রুত রিসডা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শিবির থেকে বাতিল করার দাবী উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সূত্র: দৈনিক কক্সবাজার
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-