দেশের ‘অপরিচিত’ কিছু সমুদ্র সৈকত

দেশের জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতগুলোর মধ্যে সেন্টমার্টিন শীর্ষে

সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর কথা বললেই মানুষ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, কোথায় যাবেন? কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, পতেঙ্গা নাকি কুয়াকাটা? সৈকতগুলো মানুষের কাছে এতটাই পরিচিত, অন্য কোনো নাম কারো মুখ দিয়ে শোনাই যায় না। কিন্তু আমাকে ‘অফবিট’ গন্তব্যগুলোই সবসময় বেশি টানে। এ কারণেই দেশের ‘অপরিচিত’ বেশ কয়েকটি সৈকত ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার।

শ্যামলাপুর সমুদ্র সৈকতের কথা অনেকেরই অজানা। টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নে শামলাপুর সমুদ্র সৈকত অবস্থিত। এ সৈকত খুব বেশি সরব থাকে না। মাছধরার নৌকা আর জেলেরা ছাড়া সেই ভাবে কোনো মানুষজন চোখে পড়বে না, ঝাউবনে পাওয়া যাবে সবুজ ছোঁয়া। অনেকে একে বাহারছড়া সমুদ্র সৈকত নামেও ডাকেন। এখানকার দৃষ্টি নন্দন ঝাউবনে ঘেরা অপরূপে শোভিত নির্জন সৈকতে এসে ভালো লাগার ষোল আনাই পাবেন!

শ্যামলাপুর সমুদ্র সৈকত

শ্যামলাপুর সমুদ্র সৈকত

এই সমুদ্র সৈকতের চারপাশ পাল্টে যায় ক্ষণে ক্ষণে। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি আবার কখনো দমকা হাওয়া। এখন শরৎকাল হওয়ায় জায়গাটির সব রঙই ধরা দেবে আপনার চোখে। বিশেষ করে নজর কাটবে পড়ন্ত বেলায় দৃশ্যগুলো। জেলেরা ট্রলারগুলোকে টেনে তুলে রাখে সৈকতে। পাশের ঝাউবনে সমুদ্রে বাতাসের হিল্লোল মনকেও ছুঁয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে বেলাভূমি জুড়ে। এ যেন এক স্বর্গীয় আবহ।

কটকা সমুদ্র সৈকত—নামটি পরিচিত হলেও এই বীচে মানুষের আনাগোনা নেই খুব একটা। গেলেই দেখবেন পুরো সমুদ্র সৈকত জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাদা সাদা ‘মুক্তার’ দানা। লাল কাঁকড়া আর কালো ঝিনুকেরও দেখা মিলেছে, তবে সাদাগুলো চোখে পড়ছিল বেশি। পানির ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। যত এগুতে থাকবেন, দেখবেন একদিকে ছোট গাছের ঝোপঝাড়, অন্যদিকে ছোটবড় অনেক গাছ উপড়ে পড়ে আছে, কাঠগুলো নরম হয়ে গেছে, কিছু গাছ শুধু দাঁড়িয়ে আছে, পাতা নেই, কাণ্ড নেই, জীবন নেই। দেখেই বুঝতে পারবেন এসব সিডরেরই স্মৃতিচিহ্ন।

কটকা সমুদ্র সৈকত

কটকা সমুদ্র সৈকত

কটকা জায়গাটি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে অবস্থিত। এখানকার আসল রূপ ও প্রাণিকূলের খেলা দেখতে পৌঁছুতে হবে যত সম্ভব ভোর বেলায়। ঘাটে পৌঁছানের আ্গেই দূর থেকে দেখতে পাবেন হরিণ দলবেঁধে নদীর পাড় দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বানর দৌড়াচ্ছে, বন্য শূকর কি যে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কটকাতে ঘাটে নামার পর থেকেই চেষ্টা করবেন যত দূর নীরব থাকা যায়, কোলাহল শুনলেই হরিণ দৌড়ে বনে ঢুকে যাবে। এখানে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এদের কাণ্ড দেখতে পারেন।

কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া দ্বীপের কথা অনেকেরই জানা। কিন্তু সেখানেও যে ‘মুগ্ধকর’ একটি সৈকত আছে, তা অনেকেরই অজানা। দ্বীপটির পশ্চিমপ্রান্তজুড়ে পুরোটাই সমুদ্র সৈকত। এ সমুদ্র সৈকতেও খুব বেশি পর্যটনের আনাগোনা নেই। স্থানীয়রা বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় জমিয়ে আড্ডা দেন সৈকতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পাশাপাশি এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাও বিচিত্র। প্রাকৃতির নানা বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আজন্ম লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জীবনযাত্রা উপভোগ করা যায় ছোট্ট এই দ্বীপে।

কুতুবদিয়া সৈকত

কুতুবদিয়া সৈকত

কক্সবাজারে আরো কয়েকটি মনোমুগ্ধকর সৈকত রয়েছে; যেগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা একেবারেই কম। এরমধ্যে সোনাদিয়া দ্বীপ অন্যতম। যাতায়াত কষ্টসাধ্য বলেই পর্যটকরা তেমন ভেড়েন না ওই দিকে৷ শীতের মৌসুমে ‘স্পিডবোট’-এ সোনাদিয়া যাওয়া যায়। তখনো মহেশখালী চ্যানেল আর সমুদ্রের মোহনায় বিস্তর ঢেউ থাকে। বর্ষা মৌসুমে তো মহেশখালী যাওয়াই বন্ধ হয়ে যায়। মহেশখালীর ধলঘাটা সমুদ্র সৈকতের নাম হয়ত শুনেননি অনেকেই। আমি সর্বশেষ গিয়েছিলাম চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। খুবই নির্জন সৈকতে নানান পাখির বিচরণ দেখেছিলাম; বেশ মুগ্ধও হয়েছি।

প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ বালুকাময় সৈকত পারকি। চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষদের কাছে সৈকতটি পরিচিত হলেও সারাদেশের পর্যটকদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। চট্টগ্রাম শহর থেকে দৃষ্টিনন্দন এই বিচটির দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। তাই মাত্র এক ঘণ্টা সময়ের মাঝেই শহর থেকে চলে আসা যায় এখানে। একদিকে ঝাউবনের সবুজের সমারোহ, আরেকদিকে নীলাভ সমুদ্রের বিস্তৃত জলরাশি আপনাকে স্বাগত জানাবে। একান্তে কিছু সময় কাটাতে পারেন। এমনকি যাওয়ার পথে দু’ধারে অজস্র সবুজ গাছের সারি আপনাকে মুগ্ধ করবে।

ডিমের চর সৈকত

ডিমের চর সৈকত

হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে মূলত গিয়েছিলাম হরিণ দেখতে। কিন্তু সেখানকার সৈকত আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে। সত্যিই বিমোহিত হয়েছিলাম। নিঝুম দ্বীপের গোটা দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে বিস্তীর্ণ বেলভূমি। সেখানে লাল কাঁকড়া আর সামুদ্রিক পাখিদের নির্ভয় বিচরণ। নিঝুম দ্বীপের সৈকতে দেখা সূর্যাস্তের সেই মায়াময় রূপভোলা সম্ভব নয় কখনোই। পটুয়াখালীর সোনারচরও মুগ্ধ হওয়ার মতো। ২০১৬ সালে গিয়ে প্রায় দশ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতে মানুষের ছিটফোটাও দেখিনি। এ সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত–দু’টাই দেখা যায়।

সুন্দবনের শরণখোলা রেঞ্জের জনপ্রিয় একটি জায়গা হলো ডিমের চর। সপ্তাহখানেক আগেই সেখানে যাওয়া। এই সৈকতটি খুবই নির্জন এবং পরিচ্ছন্ন। বেলাভূমি জুড়ে শুধুই দেখা যায় কাঁকড়াদের শিল্পকর্ম। অন্যপাশে বিশাল কাশবন। দেখে একজন তো বলেই ফেললো, উত্তরা দিয়াবাড়ির চেয়ে কাশবনটি আরো বড়। আমাদের কেউ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে খোশগল্প করতে লাগলো, কেউ কেউ কাশফুলের মাঝে ডুব দিয়েছে। আমি দ্বিধায় পড়লাম, কোনটাতে যাব প্রথমে কাশবন না সৈকতে! সন্ধ্যায় ওপাশের বন থেকে ভেসে আসে নানা পশু-পাখির আওয়াজ। অন্যদিকে লাখ কোটি জোনাকীর আলোর মেলা আর আকাশের অসংখ্য তারা। এসব দেখতে দেখতে মুগ্ধ ও বিমোহিত না হয়ে উপায় নেই!

সমুদ্র সৈকতগুলোর নাম হয়তো অনেকেই জানেন, কিন্তু যেতে চান না। এই না যাওয়ার প্রধান কারণ হতে পারে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব। এসব সৈকতগুলোতে যেতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয় ঠিকই, কিন্তু এগুলো সবই মুগ্ধ হওয়ার মতো। ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা, উন্নতমানের হোটেল-মোটেল থাকলে এসব সমুদ্র সৈকত পর্যটক টানবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও খবর