কক্সবাজারে ১৫৭ প্রভাবশালীর দখলে ৫০০ একর ভূমি

আবু তাহের, সমকাল •

কক্সবাজার শহরে নৌপথে প্রবেশের প্রধান ঘাট কস্তুরাঘাট। জেলা প্রশাসন ও সদর থানা থেকে মাত্র কয়েকশ’ মিটার দূরে এই নৌঘাট। ঘাটের সংযোগ সড়কের দু’পাশে বাঁকখালী নদীর তীরে নানা অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলছে দখলদাররা। নদীভূমি দখলের জন্য এই প্রভাবশালী দখলদাররা টাঙিয়ে দিচ্ছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হেফজখানা ও মসজিদের সাইনবোর্ড। এরই মধ্যে বাঁকখালী নদীর ৫০০ একর ভূমি দখল করে নিয়েছে এমন ১৫৭ জন দখলদার।

বাঁকখালী নদীর এই পয়েন্টে সম্প্রতি নির্মিত হচ্ছে খুরুশকুল ব্রিজ। স্বাভাবিকভাবেই এখানে জমির মূল্য ও গুরুত্ব বেড়েছে কয়েকগুণ। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতা। নৌঘাটের পাশেই কয়েক দিন আগে দুই কক্ষের একটি ঘর তুলে সেখানে লাগানো হয়েছে তিনটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বায়তুন নূর জামে মসজিদ, তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানার সাইনবোর্ড। এভাবে অন্তত পাঁচ একর ভূমি দখল করেছে প্রভাবশালী চক্র। কোনো শিক্ষার্থী না থাকলেও এখানকার এই মাদ্রাসায় একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

মাদ্রাসার দায়িত্বপ্রাপ্ত কথিত শিক্ষক মাওলানা নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘এ তিনটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন আতিকুল ইসলাম সিআইপি। কিছুদিন ধরে আমরা এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছি। এখানে ৮-১০ জন ছাত্র রয়েছে।’ দুটি মাত্র কক্ষে মসজিদ মাদ্রাসা ও হেফজখানা কীভাবে পরিচালনা করেন, জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে নদীর চর দখল করেছেন ঠিকাদার আতিকুল ইসলাম। নদীর এই পয়েন্টে অন্য তীরে আরও অনেক ভূমি দখল করেছেন তিনি। সেখানে ভূমি ভরাট করে প্লট তৈরি করা হয়েছে। যা নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা সম্প্রতি স্থানটি পরিদর্শন করে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদে নির্দেশ দিয়েছেন।

কিন্তু প্রশাসন কোনো নির্দেশই কার্যকর করছে না। তবে অভিযুক্ত আতিকুল ইসলাম বলেন, নিজের জমিতেই মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেছেন। এ-সংক্রান্ত কাগজপত্রও তিনি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারদলীয় কিছু নেতাকর্মী জমি থেকে জোর করে মাটি তুলে বিক্রি করছে। তিনি তাতে বাধা দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ রটানো হচ্ছে।

এদিকে বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। যে তালিকার শীর্ষেই রয়েছে ঠিকাদার আতিকুল ইসলামের নাম। বাঁকখালীর অবৈধ দখলকারীদের মধ্যে ১৫৭ প্রভাবশালীর একটি তালিকা নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবপেজে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে পিতার নাম ও কোনো ঠিকানা না থাকায় এ তালিকা পূর্ণাঙ্গ হতে পারেনি। প্রভাবশালীদের রক্ষা করার জন্য এই দায়সারা তালিকা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের। তারা বলেন, প্রভাবশালীরা পাঁচশ’ একরের বেশি ভূমি দখল নিয়েছে। যদিও তালিকায় বেদখল জমির পরিমাণ সামান্য দেখানো হয়েছে। বাঁকখালী নদীর দুই তীরে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সুশীল সমাজ ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় আন্দোলন ও মানববন্ধন করেছে। প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ না থাকার অজুহাতে উচ্ছেদকে এড়িয়ে যাচ্ছে প্রশাসন।

কক্সবাজার পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, বাঁকখালী দখলকারীদের উচ্ছেদে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের নীরবতায় দখলকারীদের দাপটও বাড়ছে। তহবিল বরাদ্দ না থাকলেও উচ্ছেদ অভিযান চালানো যায়। অন্যান্য আইনি পদক্ষেপও নেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তা হচ্ছে না।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব মো. আশরাফুল আফছার বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনায় বাঁকখালীর দখলদারদের ৪২০ জনের তালিকা করা হয়েছে। তবে আইনি জটিলতা ও প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ না থাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বাকি টাকা পাওয়া গেলে শিগগিরই অভিযান শুরু করা হবে।

জেলা প্রশাসক বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনায় সিএস জরিপের ভিত্তিতে বাঁকখালীর সীমানা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তখনও জেলার নদীগুলোতে সিএস জরিপ হয়নি। এ বিষয়ে হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, আরএস বা সিএস জরিপের ভিত্তিতে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হবে।

এদিকে কক্সবাজারে একটি সভায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেছেন, দেশের বিদ্যমান আইনে নদী ইজারা দেওয়ার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি। কেউ কোনো দলিলমূলে নদী দখল করলেও আইনত তা অবৈধ। এই দলিল বাতিল করার ক্ষমতা জেলা কালেক্টরকে দেওয়া হয়েছে।

চেয়ারম্যান হাওলাদার বলেন, নদী দখলকারীদের তালিকা করে শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা নির্দেশনা পালন করবেন না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।

আরও খবর