কার নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা শিবির?

বিডিনিউজ •

শনিবার সকাল সাড়ে ১১টা। উখিয়া থেকে কুতুপালংয়ের দিকে তখন অনেক বেশি যানজট।

ছোট ছোট ট্রাকে বস্তাভর্তি নানা ধরনের মালামাল। এইসব ট্রাকের সঙ্গে রয়েছে ইঞ্জিনচালিত টম টম, বাস ও অটোরিকশা; সেই সঙ্গে অসংখ্য মাইক্রোবাস, জিপ ও প্রাইভেট কার।

ড্রাইভার স্বগতোক্তি করলেন, “ঢাকা চিটাগাং রোডে কাজের দিনেও এত জ্যাম হয় না! আর আজ তো শনিবার।”

এ পথে এত যানজট কেন জানতে চাইলে বললেন, “রিলিফ নিয়ে এরা কুতুপালং ক্যাম্পে যাচ্ছে।”

অসমাপ্ত ভবন ও ‘টু-লেট’

কক্সবাজার থেকে উখিয়া পৌঁছানোর অনেক আগে থেকেই দেখা যায় পথের দুধারে তৈরি হচ্ছে অনেক নতুন বিল্ডিং। প্রত্যেকটির গায়ে ঝোলানো আছে ‘টু-লেট’, সঙ্গে লেখা অফিস বা ফ্ল্যাট ভাড়া হবে।

এর ভেতর অনেক ভবনের কাজ আংশিক শেষ হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন এনজিওর অফিস এবং তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসা। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে দোতালা, তিনতলা অনেক ভবন।

মালিকদের উদ্দেশ্য একই; তারা ধরেই নিয়েছেন, এইসব এনজিও অনেক দিন থাকবে। অতএব এখন ভবন নির্মাণে বিনিয়োগ করা হবে লাভজনক।

শুধু অফিস বা বাসা নয়, রাস্তার পাশে চলছে নর্থ এন্ডের মত কফি শপের জমজমাট ব্যবসা। একজন সাংবাদিক ও একজন এনজিওকর্মী বললেন, এসব কফি শপ সব সময়ই পরিপূর্ণ থাকে।

প্রকৃতি চাপা পড়েছে বসতিতে

উখিয়া থেকে কতুপালংয়ের দিকে যেতে দুপাশের প্রকৃতি যে কারো মন কেড়ে নেবে। সবুজ ধানের ক্ষেত যেমন আছে, তেমনি আছে পাহাড় ঘেরা সবুজ জঙ্গল।

এসব পাহাড়ে এখনও ‘বন্য হাতি চলাচলের পথ’ লেখা অনেক সাইনবোর্ড আছে। তবে একজন আইনজীবী জানালেন, রোহিঙ্গাদের আগমনে বেড়ে গেছে জনসংখ্যার চাপ; বন্য হাতিরা আর এদিকে তেমন আসে না।

এরকম সবুজ পাহাড় কেটে, ধানক্ষেত চাপা দিয়ে বাংলাদেশের সাড়ে ছয় লাখ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্র। টিন আর ত্রিপল মোড়া ছোট ছোট ঘর ছাড়া অন্য কিছুর চিহ্ন এখন আর সেখানে নেই।

এই সাড়ে ছয় লাখ একর জমি শুধু সরকারের ছিল না। স্থানীয় অনেকে হারিয়েছেন তাদের জমি। প্রথমে তারা মনে করেছিলেন রোহিঙ্গারা সাময়িকভাবে এ জমিতে আশ্রয় পাচ্ছে। হয়ত শিগগিরই নিজেদের দেশে ফিরে যাবে।

কিন্তু জমির মালিকরা এখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাদের জমি ফেরত পাওয়ার আশা প্রতিদিনই কমছে।

ক্যাম্পের মুখে স্থায়ী বাজার

কুতুপালং ক্যাম্পে ঢোকার মুখে দাঁড়ালে এখন আর বোঝার উপায় নেই যে এটা শরণার্থীদের একটি ক্যাম্প। মনে হয়, কোনো এক জনপদের ছোটখাটো অথচ জমজমাট এক বাজারে এসে দাঁড়ানো গেল।

গয়নার দোকান থেকে শুরু করে সব ধরনের দোকান আছে সেখানে। তৈরি পোশাক, প্রসাধনী, জুতার দোকান- কী নেই! বিভিন্ন দোকানে টয়লেট টিস্যু ও ফেসিয়াল টিস্যুও দেখা গেল।

এই বাজার ধীরে ধীরে ঢুকে গেছে ক্যাম্পের ভেতরে। বাজারে দেখা গেল বোরকা পরা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী এসেছেন কেনাকাটা করতে। মুখের যে অংশটুকু দেখা যায়, সেটুকু বার্মিজ কায়দায় সুন্দর করে প্রসাধনচর্চিত। হুট করে দেখে তাদের শরণার্থী বলে মনে হবে না।

বাজার ধরে কিছুটা এগোতেই দেখা গেল স্টিলের পাত কেটে ট্রাংক তৈরি করছেন এক ব্যক্তি। নাম জিজ্ঞেস করলে বললেন, আফালাতন।

২৯ বছর আগে বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন আফালাতন। বাবা ট্রাংক তৈরির ব্যবসা করতেন, এখন তিনি এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাজারে ট্রাংকের ব্যবসা করছেন।

একজন এনজিওকর্মীর কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে আসা রোহিঙ্গাদের এই ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে। তাদের নানা কাজ ও দায়িত্ব পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

তবে কেন এটা করা হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারলেন না ওই এনজিওকর্মী।

স্থানীয় একজন সাংবাদিক বললেন, যে এনজিওগুলো এ কাজ করেছে, তারা জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত স্থানীয় এনজিও।

তবে প্রশাসন কেন ওই এনজিওদের কথা শুনে এর অনুমোদন দিল, তা বলতে পারলেন না তিনি। ওই সংবাদিক জানালেন, প্রশাসনকে বার বার প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর তিনি পাননি।

‘ন্যাচারাল ইমিগ্রেশন’

মূল বাজার ছাড়িয়ে ক্যাম্পের আরও ভেতর দিকে এগোলে রাস্তার দুপাশে মাঝে মাঝে দোকান ও রেস্তোঁরার দেখা মেলে। এরকম একটি খাবারের দোকানে বসে ছোলাভাজি আর মুড়ি খাচ্ছিলেন দুজন।

তাদের একজনের নাম আবুল কাসেম, অন্যজন আব্দুল্লাহ। দেখলে বোঝা যায়, আব্দুল্লাহ রোহিঙ্গা নন। গোল মুখ, চাপা নাক, গায়ের রঙ বর্মীদের মত।

জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আব্দুল্লাহ নাম নেয় সে। আগে সে ছিল বৌদ্ধ, তখন নাম ছিল প্লে অং সে।

আব্দুল্লাহ জানালো, কাজের খোঁজেই সে বাংলাদেশে এসেছিল। এখন ধর্ম বদল করায় আর আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরতে পারছে না।

ওই খাবার দোকানে কাসেম আর আব্দুল্লাহর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রোহিঙ্গা না হলেও মিয়ানমার থেকে অনেকে বাংলাদেশে আসে কাজের জন্য, জীবিকার জন্য। পৃথিবীর অনান্য সীমান্তের মতই এটা যেন ভালো অর্থনীতির দিকে ‘ন্যাচারাল ইমিগ্রেশন’।

‘যৌবন রক্ষার’ ইউনানী ওষুধ ও শিশু স্বাস্থ্য

শরণার্থী শিবিরের আশপাশে বিভিন্ন ওষুধের দোকানে দেখা গেল ‘যৌবনবর্ধক’ ইউনানী ওষুধের রমরমা। এখানে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যে খুব একটা কেনার দরকার হয় না, তা ৫০ গজ পথ ‘সার্ভে’ চালিয়েই বোঝা গেল।

এই ৫০ গজ পথে ৪৯টি শিশুকে দেখা গেল, যাদের বয়স ৫ থেকে ৮ বছর। আরও পাঁচটি শিশু ছিল, যাদের বয়স দুই বছরের কম। অর্থাৎ, এই পাঁচজনের জন্ম বাংলাদেশে।

দুই বছরের কম বয়সী প্রতিটি বাচ্চার স্বাস্থ্য বেশ ভালো। বাকি ৪৯টি শিশুর মধ্যে একটির ঠোঁটের কোণায় দেখা গেল সামান্য সাদাটে দাগ। অর্থাৎ তার হয়ত ভিটামিন ‘সি’ এর অভাব আছে। তার স্বাস্থ্যে অবশ্য অন্য কোনো সমস্যা চোখে পড়ল না। কারও পোশাকেও কোনো ঘাটতি নেই। সবার পরনে জিনস, টি-শার্ট।

পানির ব্যবস্থা

যে কোনো শরণার্থী শিবিরে স্বাস্থ্য সমস্যা ও প্রাণহানির বড় দুটো কারণ হল বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব ও পুষ্টিকর খাবারের অভাব। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে খাবার বা পানি- কোনোটারই ঘাটতি নেই।

শিশুদের স্বাস্থ্য দেখে বোঝা যায়, প্রয়োজনীয় খাবার তারা পাচ্ছে। টিউবওয়েল ও পানি সরবরাহেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া সবার পায়ে দেখা গেল স্যান্ডেল, ফলে কৃমির ভয়ও কম।

মোবাইলে গান ও মেরামতের দোকান

গত ২৫ অগাস্ট রোহিঙ্গা শিবিরে সমাবেশের পর সরকার এ এলাকায় মোবাইল ফোনের থ্রিজি ও ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের যে বৈধভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারার কথা নয়, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে।

তবে সরকারের নির্দেশনার তেমন কোনো প্রভাব কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে দেখা গেল না। প্রায় সবাই সেখানে মোবাইলে কথা বলছে।

যতদূর জানা গেল, কয়েকটি এনজিও, পুরনো রোহিঙ্গা আর জামায়াত-বিএনপির লোকজন শুরু থেকেই এদের সিম জোগাড় করতে সাহায্য করেছে। অনেকে আবার মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে।

রাস্তার পাশে জিনস আর টি-শার্ট পরা এক কিশোরকে দেখা গেল পা দোলাতে দোলাতে মোবাইল ফোনে এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছে। কিছুদূর এগোতে দেখা গেল মোবাইল ফোন মেরামতের একটি দোকান।

দোকানির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, তার ব্যবসা ভালোই চলছে। তার হিসেবে ক্যাম্প এলাকায় যাদের হাতে ফোন আছে, তার ১০ শতাংশ স্মার্ট ফোন, বাকিগুলো সাধারণ মোবাইল।

অবশ্য তার দোকানে রাখা মোবাইল গুণে দেখা গেল, ৯৬টি সাধারণ সেট, স্মার্টফোন ১৬টি।

‘ভালো আছেন?’

সাড়ে চার থেকে পাঁচ বছরের শিশু রহিম ও রেহান। পরনে হলুদ টি-শার্ট আর জিনস। আমাদের দেখেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো সামনে। সমস্বরে বললো- “কেমন আছেন? ভালো আছেন?”

উত্তরে বললাম- “তোমরা কেমন আছো?”

উত্তর পেয়ে খুশিতে ভরে গেলো তাদের মুখ। এই খুশির একটি কারণ তারা বাংলা শিখতে পেরেছে। বাংলায় কথা বলতে পারছে।

জানতে চাইলাম, সকালে কী খেয়েছে তারা। রহিম ও রেহানের সঙ্গে আরও কয়েকজন উত্তর দিল, স্কুল থেকে নাশতা দেয়, সেটাই খেয়েছে।

যে লার্নিং সেন্টারে তারা পড়ছে, সেখানে বাচ্চাদের সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইউএনএইচসিআর-এর সহযোগিতায় মুক্তি নামের একটি এনজিও (যেটা সরকারি আদেশে বন্ধ থাকার কথা) ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ওই লার্নিং সেন্টার চালাচ্ছে। ৩৫০ জন শিশু সেখানে বাংলা শিখছে।

ওই লার্নিং সেন্টার থেকে সামান্য দূরে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের একটি অফিস। সেখানে একটি বোর্ডে ইংরেজি ও মিয়ানমারের ভাষায় কয়েকটি লাইন লেখা। রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা শেখানোর বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করলেন এনজিওটির কর্মীরা।

অবশ্য উখিয়ার একজন আইনজীবী বললেন, এনজিওগুলো শুধু বাংলাই শেখাচ্ছে না, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাও শেখাচ্ছে।

মুরগীর খামার

ওই লার্নিং সেন্টারের একটু আগেই রাস্তার ডান পাশে তিন-চারটি মুরগির খামার। বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় রোহিঙ্গারা এই খামার করেছে।

স্থানীয় একজন সাংবাদিকের বক্তব্য হল, শুধু মুরগির খামার নয়, রোহিঙ্গাদের উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করে তাদের স্বনির্ভর করার চেষ্টায় আছে এনজিওগুলো।

তার হিসাবে, প্রায় সাত হাজার টমটম ও অটোরিকশা রয়েছে রোহিঙ্গাদের হাতে। তারা যাতে বাংলাদেশের বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারে সেজন্যই এনজিওগুলো এসব করছে বলে ওই সাংবাদিকের ধারণা।

সরকার চল্লিশটি এনজিওর কাজ বন্ধ করার যে নির্দেশ দিয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি হেসে বললেন, “আপনি নিজে মুক্তির কাজ দেখে এসেছেন না? আর যারা সরাসরি করার সাহস পাচ্ছে না, তারা অন্যের সঙ্গে করছে, যেমন মুসলিম এইড কাজ করছে আল মাজোর সঙ্গে।”

রোহিঙ্গারা চাকরিতেও

শরণার্থীদের চাকরি করার সুযোগ থাকার কথা নয়, বাংলাদেশের আইনেও সে সুযোগ নেই। তারপরও এনজিওগুলোর বুদ্ধিতে রোহিঙ্গাদের চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানালেন স্থানীয় এক সাংবাদিক।

এনজিওগুলো এখানে একটি কৌশল বের করেছে। তাদের যুক্তি, শরণার্থীরা স্থায়ীভাবে কাজ করতে নার পারলেও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতে পারে। সেভাবেই তাদের নিয়োগ দেখানো হয়েছে।

একজন এনজিও কর্মী জানালেন, মোটামুটি সব এনজিওতেই ভলান্টিয়ার হিসেবে রোহিঙ্গারা আছে। এমনকি কর্মী হিসেবেও তাদের চাকরি হয়েছে।

তার বক্তব্য হল, রোহিঙ্গারা অশিক্ষিত বলে সাধারণ একটি প্রচার থাকলেও তা পুরোপুরি ঠিক নয়। রোহিঙ্গারা সবাই যে অশিক্ষিত বা দরিদ্র- এমন ধারণা ভুল।

রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ঘুরেও তার এ কথার সত্যতা পাওয়া গেছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে দল বেঁধে মসজিদে নামাজে যাওয়ার সময় রোহিঙ্গাদের দেখলেই বোঝা যায়, এদের অনেকেরই আর্থিক সঙ্গতি ভালো।

ওই এনজিও কর্মকর্তা জানালেন, রোহিঙ্গা পরিবারের ছেলেদের অনেকেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ‘বেশ ভালো’। তবে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম।

সবচেয়ে বড় দিক হল, এরা ভালো ইংরেজি বলতে পারে। বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তারা এলে এনজিওর পক্ষে বা রোহিঙ্গাদের পক্ষে তারাই কথাবার্তা বলে।

ওই কর্মকর্তা বললেন, কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা রাষ্ট্রদূত যখন এসেছিলেন, রোহিঙ্গারা নিজেরাই তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। যে রোহিঙ্গারা চাকরি করছে তারা মাসে ১৮ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকাও বেতন পাচ্ছে। তবে তাদের বেতনের হিসাব দেখানো হয় ঘণ্টা ভিত্তিতে।

প্রবাসী আয়ও আসছে রোহিঙ্গা শিবিরে!

রোহিঙ্গাদের অনেকেই নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাদের পাঠানো অর্থ এখন হুন্ডির মাধ্যমে কক্সবাজারের আশ্রয়কেন্দ্রে স্বজনদের হাতেও আসছে। আর এর পেছনে স্থানীয় কিছু এনজিও জড়িত থাকারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশ থেকে আসা অর্থ পলিথিনে মুড়ে ঘরের মেঝের নিচে লুকিয়ে রাখছে কেউ কেউ।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা যে পরিমাণ সাহায্য পাচ্ছে, তার পুরোটা তাদের লাগে না। বাড়তি অংশ তারা বিক্রি করে দিচ্ছে, আর সেসব সামগ্রী নিয়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যবসা।

‘অবৈধ ব্যবসায়’ মাঝিরা

সরকার ক্যাম্পের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রোহিঙ্গাদের ভেতর থেকে নেতা মনোনীত করে দিয়েছে, যাদের বলা হয় মাঝি। তবে শুরুতেই তাদের হাতে ওইভাবে নেতৃত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করছেন একজন এনজিওকর্মী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “এর ফলে রোহিঙ্গারা যেমন সংগঠিত হয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারছে, তেমনি এই মাঝিরা প্রায় সকলে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। রিলিফ নিয়ে যত দুর্নীতি হচ্ছে তার বড় অংশ হচ্ছে এই মাঝিদের মাধ্যমে। কুতুপালংয়ে ৩২টা ক্যাম্পে এরকম মাঝি আছে ২২০০।”

লিডারশিপ ট্রেনিং

স্থানীয় একজন সাংবাদিক বললেন, এনজিও ব্যুরোর অনুমতি এনে একটি এনজিও রোহিঙ্গাদের লিডারলিপ ট্রেনিং দিচ্ছে।

“এই ট্রেনিং চলতে পারে কিনা- সে বিষয়ে লোকাল ডিসি বা এসপি কারও মাধ্যমে কোনো তদন্ত হয়নি। ওই ট্রেনিংয়ে তাদের শেখানো হচ্ছে- কীভাবে আন্দোলন করতে হবে, কীভাবে সমাবেশে জড় হতে হবে, আরও নানান ধরনের কৌশল। কেন এটা করা হচ্ছে তার খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই।”

ওই লিডারশিপ ট্রেনিং গত ২৫ অগাস্টের সমাবেশ আয়োজনে ‘ভালো কাজ করেছে’ বলে মনে করেন ওই সাংবাদিক।

প্রশাসন কেন জানলো না?

ক্যাম্পের খাবারের দোকানে ছোলা-মুড়ি খাচ্ছিলেন যে আবুল কাসেম, তিনি চার মাইল হেঁটে গত ২৫ অগাস্ট ওই রোহিঙ্গা সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন।

একজন এনজিও কর্মকর্তা বলেন, তাদের ভলান্টিয়ার ও অন্য রোহিঙ্গা কর্মীরা আগেই জানিয়েছিল, ২৫ তারিখ তারা কাজে আসবে না। ২০১৭ সালের ওই দিন মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। সে কারণে তারা ওই দিনটি কর্মবিরতি করবে।

তবে ওই এনজিও কর্মকর্তা সে সময় বুঝতে পারেননি, সমাবেশ যাওয়ার জন্যই রোহিঙ্গা কর্মীদের এই কর্মবিরতি। পরে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন।

সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সঙ্গে ইউএনএইচসিআরের যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে শরণার্থী শিবিরে স্থানীয় প্রশাসনের খুব বেশি কিছু করার নেই।

আশ্রয়কেন্দ্রের কিছু কিছু এলাকায় ‘লক বেইজ’ করা হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গা ও এনজিওকর্মী ছাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা ওসিরও প্রবেশাধিকার নেই। ফলে স্থানীয় প্রশাসন ওই সমাবেশের মূল পরিকল্পনার বিষয়ে আগে থেকে ভালোভাবে জানতে পারেনি।

নৌকার মাঠে ‘ট্রেনিং’

কুতুপালং ক্যাম্পের ভেতর একটি মাঠ আছে, যার নাম নৌকার মাঠ। স্থানীয়দের ভাষ্য, সেখানে রাতে পালা করে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হয়। রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত সেই ট্রেনিং চলে। একের পর এক গ্রুপ সেখানে ট্রেনিং নেয়।

একজন সাংবাদিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের ওই ট্রেনিংয়ের পেছনে রয়েছে ‘আল-ইয়কিন’ নামের একটি গ্রুপ। কেন নাম প্রকাশ করতে চান না জানতে চাইলে ওই সাংবাদিক বলেন, “প্রাণের ভয়ে।”

ওই সাংবাদিকের বাড়ি উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের কাছে। স্থানীয়দের অনেকেই ভয়ে আছেন বলে জানান তিনি।

“রোহিঙ্গারা সংখ্যায় সাড়ে ১১ লাখ, আর স্থানীয়রা মাত্র ৪ লাখ। স্থানীয়রা নিরস্ত্র, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র আছে। মূলত এই অস্ত্রধারীরাই এখন রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করে।”

কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের হাতে লোহার তৈরি রামদাসহ নানা ধরনের ধারালো অস্ত্র সরবরাহ করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে। ফলে স্থানীয়দের মধ্যে ধীরে ধীরে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে বলে জানান ওই সাংবাদিক।

‘ইয়াবার কারবার’ রোহিঙ্গা শিবিরে

স্থানীয়দের মধ্যে যে কথা চালু আছে, তা হল ১৪০ জন মাদক চোরাকারবারি চলতি বছরের শুরুতে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করার পর সীমান্তের ওপারের ইয়াবা কারখানার মালিকরা তাদের কারবার চালু রাখতে রোহিঙ্গা শিবিরে তাদের পুরনো পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

পাশাপশি ওই এলাকায় মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা হয়। এখন আশ্রয় শিবিরের কিছু রোহিঙ্গা ‘গডফাদারের’ মাধ্যমে পুরো ইয়াবার কারবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বলে স্থানীয়দের ধারণা।

নিয়ন্ত্রণে কে?

বাংলাদেশ সরকারের ৬.৫ লাখ একর জমির ওপর রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ওই এলাকাটি নয়টি ইউনিয়নের অধীনে। এই নয় ইউনিয়ন পরিষদের ৯ জন চেয়ারম্যান এবং ৯৯ জন সদস্যের কর্তৃত্ব নেই আশ্রয় শিবিরে।

স্থানীয়রা বলছেন, সারা রাত এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ থাকে ‘সন্ত্রাসী গ্রুপের’ হাতে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কার্যক্রম তখন সেখানে থাকে না।

ফলে স্থানীয় অনেকের মধ্যেই এই প্রশ্ন ঘুরছে- বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এই রোহিঙ্গা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

সৌজন্যে: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর

আরও খবর