ফুয়াদ মোহাম্মদ সবুজ
সংবাদপত্র সমাজের দর্পন বা আয়না। আর সাংবাদিকতা একটি মহান ও পবিত্র পেশা। সংবাদপত্র রাষ্ট্রে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবেও স্বীকৃত। আর সাংবাদিকতাকে জাতির বিবেক বলা হয়। সংবাদপত্র ও সাংবাদিক শব্দ দু’টি আলাদা হলেও পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। আয়নায় যেমন নিজের চেহারা প্রতিবিম্বিত হয়, তেমনি দেশ, জাতি, সমাজ তথা বিশ্বের চলমান ঘটনা, মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তাচেতনা, জাতীয় স্বার্থ ও দিকনির্দেশনা সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয়। সংবাদিকতা পেশায় রয়েছে ঝুঁকি, রয়েছে সম্মান ও রোমাঞ্চ। অপসাংবাদিকতা বাদ দিলে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে সবটুকুই আত্মতৃপ্তি পাওয়ার একটি স্বাধীন পেশা।
একজন সৎ নির্ভিক ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক সমাজে সমাদৃত, সবাই সম্মান করে। সাংবাদিকতা যেমন দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও সমাজ বিরোধীদের কাছে আতংক, তেমনি অপসাংবাদিকতাও সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। আমরা উপকূলীয় অঞ্চলে যারা এ পেশায় আছি, তারা কতটুকু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছি?
সমাজ পরিবর্তনে কতটুকু ভূমিকা রাখছি? অন্যায়ের প্রতিবাদে ক’জনে কলম ধরছি? অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে কেন কথা বলছি না? আমাদের পেশায় অন্যায়কারী থাকলে আমরা কিভাবে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে কথা বলবো বা প্রতিবাদ করবো? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই আমার আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য। এ অঞ্চলের দায়িত্বশীল সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতাদের কাছে আমার এসকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর আশা করতেই পারি।
আমি একজন ক্ষুদ্র সংবাদকর্মী হিসেবে শিরোনামের বিষয়ে লেখার ইচ্ছা ছিলো না। তারপরেও বিবেকের তাগিদে লিখতে হচ্ছে। তাই সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় কর্মরত দায়িত্বশীল সংবাদকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই শুরু করছি আজকের লেখা। তবে আজকের লেখায় মহেশখালী উপজেলার বাহিরে যাচ্ছি না। একটি উপজেলার সমস্ত অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধ করতে এবং সমাজ পরিবর্তনে সংবাদকর্মীর সংখ্যাটি কত লাগবে? কতজন সংবাদকর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করলে সম্ভব হবে? এই প্রশ্নটি আমি উপজেলার সাংবাদিক সমাজের প্রতি রাখলাম। বিশেষ করে যারা দায়িত্ববোধ নিয়ে এ পেশায় আছেন।
গাড়ির সামনে ইংরেজী অক্ষরে প্রেস লেখা। আবার একদল আছে সাংবাদিকের ভাই বলে গাড়িতে প্রেস লিখে ঘুরছে। এরা কিন্তু সাংবাদিকতার নামে অন্তত চাঁদাবাজি করে না। শুধু প্রশাসনের ঝামেলা এড়াতে সাইনবোর্ড ব্যবহার করে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে পরিচয়ও দেয় না।
এ সংখ্যাটি ব্যাপক আকারে বেড়েছিলো গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। এক একটি ভোট কেন্দ্রে ভোটারের চেয়ে কার্ডধারী সাংবাদিক বেশি ছিলো! তা অবশ্য ভালই ছিলো। কারণ তাদের টাকাওয়ালা পছন্দের প্রার্থী জয়ী ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে কার্ড হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে যে কার্ডধারী প্রেসমার্কা সাংবাদিকের জন্ম হচ্ছে, তারা কিন্তু খুবই ভয়াবহ। সাংবাদিকতা পেশা হুমকির পাশাপাশি মহাবিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে। কারণ এরা দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী। তাই আমার মনে হয় সাবধান হওয়ার সময় এখনই এসেছে।
পরবর্তীতে হিসাব মিলানো কঠিন হতে পারে।
সম্প্রতি আমার এক ছোট ভাই, আমাকে ডেকে এক সংবাদকর্মীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। পকেট থেকে একটি কার্ড বের করল। দেখি ঢাকার একটি পত্রিকার ষ্টাফ রিপোর্টার সে। কাজ করবে মহেশখালী। কৌতুহল বশতঃ জানতে চাইলাম কার্ড আনতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে। অকপটে বলে দিলো ১০ হাজার টাকা। এরপর কতক্ষণ কথা বলে দেখলাম সাংবাদিকতা সম্পর্কে তার ন্যূনতম ধারনাটুকুও নেই। তবুও সে ষ্টাফ রিপোর্টার। তাও ভাল, কারণ এখনও সে সাংবাদিকতা করতে বা তথ্য সংগ্রহ করতে কোথাও যায়নি। কিন্তু যারা শুরু করে দিয়েছে তাদের কি বলবো? তারা যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয় পরিচয় দেয়, তা শুনে তাদের সাথে কথা বলার সাহস ব্যক্তিগতভাবে আমার নেই! তারপর এলাকার সাধারণ মানুষ? ভাবতে হবে আপনাদের।
সম্প্রতির একটি ঘটনা বলি। স্বামী-স্ত্রী ডিভোর্স হয়ে গেছে। ওই দম্পত্তির একটি কন্যা সন্তান ছিলো। বাবায় আবার বিবাহ করছে। মায়েরও বিবাহ হয়েছে। বাবায় কন্যা সন্তানটির বিবাহ দিয়েছে। মেয়েটির বিয়ের ৮ মাসের মাথায় মাকে দেখার জন্য তার মায়ের নতুন সংসারে বেড়াতে এসেছে। এই খবর পৌঁছে গেলো এক সংবাদকর্মীর কানে। সদ্য কার্ডধারী ওই সাংবাদিক তার উপজেলা প্রতিনিধিকে নিয়ে সন্ধ্যা ৮টার দিকে চলে গেলেন সেই বাড়িতে। উপজেলা প্রতিনিধি ও তার বন্ধু এবং মোটরসাইকেল চালকসহ ৪ জন। বাসায় কোন পুরুষ লোক ছিলেন না। প্রথমে বাসার লোকজন ভয়ই পেলেন। পরক্ষণে তারা সাংবাদিক পরিচয় দিলেন।
অভিযোগ ওই কন্যা সন্তানের আট মাস পূর্বে বাল্যবিবাহ হয়েছে। যথারীতি বাসার মহিলারা পুরুষের কাছে ফোন করলেন। কিন্তু সংবাদকর্মী মহোদয়রা অপেক্ষা করতে চাইলেন না। তারা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে ক্যামেরার লাইট জ্বালিয়ে ছবি তুলতে আরাম্ভ করলেন। এক পর্যায়ে মহিলারা ঘরের পিছনে চলে গেলেন। চলে গেলেন সংবাদকর্মীরাও। মোট কথা ছবি ও ফুটেজ নিতে হবে, তা না হলে পাঁচ হাজার টাকা লাগবে।
বাসায় মহিলারা ফোনে পুরুষ লোকটিকে পাঁচহাজার টাকার কথা জানালেন। নিরুপায় হয়ে লোকটি আমার কাছে ছুটে এলেন। ঘটনার বর্ণনা দিলেন। আমি বিস্তারিত শুনে তাকে বাসায় ফোন করতে বললাম। তিনি ফোন করলেন। আমি সংবাদকর্মীদের সাথে কথা বললাম। কিন্তু তারা আমাকে চিনলেন না, আমিও তাদের চিনলাম না। আমি তাদেরকে আমার অফিসের আসার জন্য অনুরোধ করে ঠিকানা দিলাম। তারা আসতে রাজি হলেন না, বললেন তাদের একটা ফুটেজ বাকি আছে। বাসার মালিকসহ আরও কয়েকজনকে পাঠিয়ে দিলাম, আমার অফিসে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু সংবাদকর্মীর রাজনৈতিক পরিচয় শুনে রীতিমতো ভয়ই পেলেন তারা।
আমার অফিসে পরিচিত হলাম। মাঠে-ঘাটে তথ্য সংগ্রহ করার কৌশল জানতে চাইলাম। কিছুই বলতে পারল না। সহজ কথায় বলে দিলো ‘আমরা অল্প কয়েক দিন হয়েছে কাজ শুরু করছি’। তারপর মোটামুটি একটু ধারনা দেওয়ার চেষ্টা কলাম। কিন্তু কোন লাভ হলো না। মোবাইলে ধরিয়ে দিলেন ঢাকার এক সাংবাদিকের সাথে কথা বলার জন্য (তাদের কাছে যিনি কার্ড বিক্রয় করেছেন)। ঢাকার ওই ব্যক্তির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝলাম তার অবস্থাও একই। সবশেষ সাংবাদিক নিয়োগের নামে বাণিজ্য বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে কথা শেষ করলাম।
বর্তমানে অনলাইন নিউজ পোর্টালের তো আর অভাব নাই। এত সাংবাদিক পাবে কই? তাই যাকে পায় তাকে একখানা কার্ড ধরিয়ে দেয়। আর বলে দেয় ‘যাও কামাই করে খাও’! আর স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো সাংবাদিক নিয়োগ দেয় না, হকার নিয়োগ দেয়। পত্রিকা বিক্রির জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ করে। তারপর সে যা করে করুক। পত্রিকা বিক্রি করুক আর সাংবাদিকতা করুক, শুধু মাস শেষে বিল পেলেই হলো। তাই ওদের দোষ কি? কে না চায় মহান পেশায় আসতে। সবাই তো সম্মান পেতে চায়। বিশেষ করে পুলিশের কাছে সাংবাদিকের মূল্যায়ন তো আছেই।
পরিশেষে এ উপজেলার সাংবাদিকতা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। চাঁদাবাজ ও ধান্দাবাজদের তালিকা তৈরী করতে হবে। প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ খোঁজা সাংবাদিক শনাক্ত করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, সত্যের পথে কলম ধরতে হবে। সাংবাদিকতার মান সম্মান অক্ষুন্ন রাখার জন্য ভাববেন সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিক নেতারা, এই প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি।”
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-