উখিয়া-টেকনাফে ১৬ হাজার মানুষের জন্য একজন পুলিশ!

আলমগীর হোসেন :

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ। সেখানে বর্তমানে বসবাসরত মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা তিনগুণ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১১ লাখ। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা মিলে এ মোট ১৬ লাখ মানুষের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে মাত্র ৯৫০ জন পুলিশ সদস্য।

হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে প্রায় ১৬ হাজার ৮৪ জন মানুষের নিরাপত্তার জন্য একজন মাত্র পুলিশ সদস্য কাজ করছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে ঠাঁই নেওয়ার এ পর্যটন অঞ্চলের নিরাপত্তা চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। এক শ্রেণির রোহিঙ্গারা খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রায় সব ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি টেকনাফ উখিয়ায় স্থানীয়দের মাঝেও ইয়াবা ব্যবসার ব্যাপক প্রচলন আছে। এসব মিলে এমন দুটি উপজেলার জন্য এত কম পুলিশ সদস্য দিয়ে এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা দুষ্কর ব্যাপার।

গত এক সপ্তাহব্যাপী কক্সবাজারে অবস্থানকালে স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। কক্সবাজার জেলা পুলিশ জানিয়েছে, পুরো কক্সবাজার জেলায় বর্তমানে রোহিঙ্গাসহ জনসংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। জেলায় মোট পুলিশ সদস্য ১ হাজার ৬০০ জন। এর মধ্যে রোহিঙ্গা যুক্ত হওয়ার কারণে কেবল টেকনাফ ও উখিয়ায় বসবাসকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ লাখ। এ ১৬ লাখের জন্য পুলিশ রয়েছে ৯৫০ জন। অপরাধপ্রবণ বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দুটি উপজেলায় নিরাপত্তার মূল দায়িত্বে থাকা পুলিশের সংখ্যা একেবারেই কম বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, টেকনাফ-উখিয়ায় নিয়োজিত পুলিশের সংখ্যা কম হলেও বিভিন্ন মাধ্যম ও কৌশল অবলম্বন করে এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। যেমন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও চৌকিদারসহ বিভিন্ন পর্যায়কে কাজে লাগিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মনিটরিং করা হয়। তিনি বলেন, পুলিশকে অন্যান্য বাহিনীও সহায়তা করছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় যেহেতু রোহিঙ্গা নাগরিকদের বসবাস রয়েছে সে কারণে এ দুটি এলাকায় বিশেষ নজরদারি রয়েছে। এখানে চব্বিশ ঘণ্টায় নিয়মিতভাবে উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবের যৌথ টহল দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গারা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ করলে চুল পরিমাণও ছাড় দেওয়া হবে না।

ইকবাল হোসেন বলেন, বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে পুলিশের ৬টি ক্যাম্প রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ কুতুপালং, মধুছড়া, ইরানীপাড়া, ময়নারগুনা, বালুখালী এবং তানজিমারখোলা। নতুন রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরে টেকনাফে দুটি এবং উখিয়ায় দুটি মোট চারটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া কক্সবাজারে প্রবেশ ও বাইরে মোট ৭টি চেকপোস্ট কার্যকর রয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কয়েকটি প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। তার মধ্যে রয়েছেÑ টহল ও অভিযানের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে শাখা রাস্তা নির্মাণ, রোহিঙ্গা বসতি ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া, ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করা, অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে আলোর ব্যবস্থা, ইন্টারনেট বন্ধ করা এবং মোবাইল ফোন নিয়ন্ত্রণ করা।

কক্সবাজারের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সময়ের আলোকে বলেন, রোহিঙ্গারা যেভাবে ভয়ঙ্কর সব সংঘবদ্ধ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তাতে সামান্য কয়েকজন পুলিশ দিয়ে বিপুল রোহিঙ্গাদের অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব। কোনো কোনো সময় রোহিঙ্গারা পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও চড়াও হচ্ছে। এ দুটি উপজেলার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক অবস্থান করছে। যার বেশিরভাগই এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে। ওই সময়ে মিয়ানমারে নিজ দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর গণহত্যা, বর্বরোচিত নির্যাতন ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক। মানবিক কারণে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের এ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিলেও এখানে ঠাঁই নিয়েই তাদের অনেকে শুরু করে ইয়াবা ব্যবসা, চুরি, ছিনতাই-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। বর্তমানে এক শ্রেণির রোহিঙ্গারা অপরাধের অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছে টেকনাফ, উখিয়াসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়। সম্প্রতি রোহিঙ্গারা টেকনাফের স্থানীয় একজন যুবলীগ নেতাকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। অপহরণ, খুন-ডাকাতি ও ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা ক্ষেত্রে এভাবেই বেপরোয়া অপরাধ ঘটিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

স্থানীয় পুলিশের তথ্যমতে, গত দুই বছরে (গত ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ৪৭১টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার আসামির সংখ্যা ১০৮৮ জন। এর মধ্যে মাদক মামলা ২০৮টি এবং হত্যা মামলা ৪৩টি। এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ৩৩ জন। সূত্র -সময়ের আলো

আরও খবর