সাঁতরে ইয়াবা আনছে প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গারা

আলমগীর হোসেন • সময়ের আলো

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফ এলাকায় নাফ নদী অধিকাংশ স্থানে প্রস্থে প্রায় চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার। খরস্রোতা এই নদী সরাসরি মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। দুই দেশের সীমান্তের মধ্যে এই দীর্ঘ নদী সাঁতরেই মিয়ানমার থেকে প্রচুর পরিমাণে ইয়াবা বাংলাদেশে আনছে এক শ্রেণির রোহিঙ্গা। যারা সাঁতারে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ইয়াবা আনার জন্যই তারা এই সাঁতার প্রশিক্ষণ রপ্ত করেছে। জানা গেছে, নাফ নদীর টেকনাফ অঞ্চলের অন্তত ২০টি পয়েন্ট দিয়ে সাঁতরে ও নৌকাযোগে ইয়াবা আনছে রোহিঙ্গা মাদকচক্র। ইয়াবাগুলো টেকনাফে আনার পর বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা নারীরা টেকনাফের স্থানীয় মাদক কারবারি নারীদের সঙ্গে সমন্বয় করে ইয়াবার চালান এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। এই নারীরা ছাড়াও ইয়াবা পাচার বা সরবরাহ প্রক্রিয়ায় অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশু, নারী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও রিকশা-অটোরিকশার চালকদের।

গত এক সপ্তাহ কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া অঞ্চলে অবস্থানকালে স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মধ্যে মাদক কারবারে জড়িত পুরুষদের অনেকেই সাঁতারের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছে। মিয়ানমারের সীমান্ত থেকে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমানায় ইয়াবার চালান আনছে প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গারা সাঁতারুরা। পূর্ব থেকে চক্রের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান জেনে বুঝে সাঁতারু রোহিঙ্গাদের নির্দেশনা দিয়ে ইয়াবার চালান আনা নেওয়া করছে। যদিও সাঁতরে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনার সময় একাধিক চালান আটক ও রোহিঙ্গা গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি সাঁতরে ইয়াবার চালান আনার সময় বিজিবির গুলিতে দুই রোহিঙ্গা নিহতের ঘটনাও ঘটে। তবে সম্প্রতি এই প্রক্রিয়ায় ইয়াবার চালান বহনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারাই সবচেয়ে ইয়াবার চালান বাংলাদেশে পাচার করছে। এর মধ্যে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণির রোহিঙ্গা সাঁতরে ছোট-বড় ইয়াবার চালান আনছে। দীর্ঘ ও জোয়ার ভাটার এই নদী সাঁতরে ইয়াবার চালান আনার বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে একাধিক সাঁতারু রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার ও নিহত হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে নাফ নদীর টেকনাফ সীমানার অন্তত ২০টি পয়েন্ট দিয়ে এসব প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা সাঁতারু চক্র ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে বেশি। বিশেষ করে টেকনাফের নাফ নদীর মুসনি ওমরখাল, সাপ্রাং সুইচগেট, হ্নীলার জালিয়ারপাড়া ও চৌধুরীপাড়া, রোঙ্গিখালীর আনোয়ারের প্রজেক্ট ও সৌরপ্যানেল এলাকা, জাদীমোরার আদমঘাট, দমদমিয়া, জালিয়ারদ্বীপ, নয়াপাড়া, উলসিপ্রাং, ঝিমনখালী, পালংখালী, মিনা বাজারসহ অন্তত ২০টি পয়েন্টে দিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকছে প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গারা। বিস্তীর্ণ নাফ নদীর ওইসব পয়েন্টের অনেক স্থানই সরু খালের মতো। ভাটার সময় সেসব পয়েন্টে হাঁটু পানি থাকে। এ কারণে অনেক সময় সাঁতরানোরও প্রয়োজন পড়ে না। কোনোমতে নদী পার হলেই পাহাড় বা ঘন জঙ্গলের মধ্যে সহজেই আত্মগোপন করতে পারে মাদকচক্র।

সরেজমিনে ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে টেকনাফে নাফ নদীর ৫৫০ মিটার দীর্ঘ জেটিতে অবস্থানকালে সেখানে টহলে আসা র‌্যাব-১৫ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তা সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার সারুয়ার সময়ের আলোকে বলেন, ট্রলার বা নৌকাযোগে বড় ইয়াবা চালানগুলো প্রবেশ করানো চেষ্টা করা হয়ে থাকে। তবে ইদানীং এক শ্রেণির প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা সাঁতারু পাঁচ থেকে পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত ইয়াবা ট্যাবলেটের চালান নিয়ে সাঁতরেই নদী পার হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকেই ধরা পড়েছে। এরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। এমন একটি নদী সাঁতরে পার হওয়াটা অনেক দুষ্কর হলেও তারা অনায়াসেই তা করছে। এ কারণে টহল ও নজরদারিও বাড়িয়েছে র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ওই জেটিতে সেদিন দায়িত্বরত বিজিবির নায়েক কালাম সময়ের আলোর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এর আগে ইয়াবার চালান সাঁতরে আনার সময় বিজিবির গুলিতে দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়। তারা এমন বিশেষ প্রশিক্ষণ ও কৌশল অবলম্বন করছে যে দূর থেকে নদী সাঁতারের বিষয়টি বোঝাও কঠিন। তবে যত কৌশলই করুক ধরা পড়ছে এসব বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাঁতারু রোহিঙ্গারা।

জানা যায়, ১৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার থেকে ইয়াবার একটি বড় চালান কক্সবাজারের টেকনাফের দমদমিয়া এলাকায় নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে পাচারের চেষ্টাকালে বিজিবির টহলের সামনে পড়ে রোহিঙ্গা মাদক চক্রের কয়েক সদস্য। এ সময় উপায় না দেখে মাদক কারবারিরা নৌকায় ১ লাখ ১০ হাজার ইয়াবা চালানের প্যাকেটগুলো রেখেই নাফ নদী সাঁতরে পালিয়ে যায়। পরে বিজিবি ওই ইয়াবাগুলো উদ্ধার করে। এর আগে গত ৫ আগস্ট নাফ নদী সাঁতরে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা আনার সময় স্থানীয় জনতার সহায়তায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নুরুল আমিন নামে এক রোহিঙ্গা।

মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এই রোহিঙ্গা নাগরিক উখিয়ার কুতুপালংয়ে শরণার্থী শিবিরে থাকত। সাঁতরে সে নাফ নদী তীরে টেকনাফের হ্নীলা নাটমোরায় উঠতে গেলে তখনই স্থানীয় লোকজন তাকে ধরে ফেলে। পরে খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাকে ওই ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে। গত ১১ জানুয়ারি টেকনাফে হ্নীলা ইউনিয়নের আনোয়ার প্রজেক্ট পয়েন্টে ইয়াবার বড় চোরাচলান নিয়ে সাঁতরে নাফ নদী পার হওয়ার সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গুলিতে দুই রোহিঙ্গা ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হন। এ সময় তাদের কাছ থাকা ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। গত ২৬ জুলাই টেকনাফের নাফ নদী থেকে ৭ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করে কোস্ট গার্ড বাহিনী। কোস্ট গার্ড জানায়, টেকনাফ স্থলবন্দরের নিকটবর্তী জাইল্লারদ্বীপ এলাকায় নাফ নদীতে কোস্ট গার্ডের অভিযান দল দেখতে পেয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মাদকচক্রের সদস্যরা নৌকা উল্টে দিয়ে সাঁতরে ক‚লে উঠে পালিয়ে যায়। তবে ইয়াবাগুলো উদ্ধার করতে পারে কোস্ট গার্ড।

আরও খবর