গোলাম আজম খান • কক্সবাজার
মাত্র এক বছর আগেও ঘুম থেকে উঠলে শোনা যেত সাগরপথে মানবপাচারের সংবাদ। শোনা যেত সাগরে মৃত্যুর খবর। কানে বাজতো স্বজনদের আর্তনাদ ও আহাজারি। সময়ের ব্যবধানে পুরোপুরি না থামলেও কিছুটা স্তিমিত হয়েছে ভয়ানক সে মানবপাচার। উখিয়া সোনারপাড়ার রেজিয়া আকতার ওরফে রেবি ম্যাডাম, রুস্তম আলীদের কথা কার না জানা? রোহিঙ্গা-বাংলাদেশী মিলেমিশে চলছিল অপ্রতিরোধ্য মানবপাচার। টেকনাফের নাফ নদী ও উখিয়ার রেজুখালকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছিল অঘোষিত মানবপাচারের ঘাট। মানবপাচার আইনের সংশোধন ও প্রশাসনের কঠোরতায় সাগরপথে এখন আর মৃত্যুর কাহিনী শোনা যায় না। তবে, সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে উঠেন ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার মানুষগুলো।
মিয়ানমারের মংডু শহরের বাসিন্দা আব্দুল খালেক। প্রায় ২০ বছর আগে বাড়িতে দুই মেয়ে রেখে তিনি মারা যান। ছোট মেয়ে আজিদা এখন ২০ বছরে পা দিয়েছে। আজিদার বয়স যখন মাত্র ৬ মাস তখন বাবা আব্দুল খালেক ওপারে চলে যান। মা তৈয়বা বেগম ও বড় বোন রোজিনা আক্তারের সাথে তার বসবাস। নানী গুলবাহার বেগম (৫০) তাদের সবাইকে দেখাশোনা করতেন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের মগ বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশে চলে আসেন। বসবাস করছেন উখিয়ার কুতুপালং ১৭ নং ক্যাম্পের বি-ব্লকে। বিয়ে হয়েছে বড় বোন রোজিনা আক্তারের।
আজিদার প্রতিবেশী সলিমুল্লাহ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়াতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যেতেন। সেখানে পদুয়ার ছেলে আরাফাতের সাথে পরিচয় হয় রোহিঙ্গা সলিমুল্লাহর। আরাফাত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসতেন সলিমুল্লাহর সাথে দেখা করতে। সেখানে আজিদার সাথে পরিচয় হয় আরাফাতের। দেখতে বেশ সুন্দর হওয়ায় আজিদার জন্য পাগল হয়ে ওঠেন আরাফাত। এভাবে দুইজনের মধ্যে মন দেয়ানেয়া চলতে থাকে বেশ কিছুদিন। একপর্যায়ে প্রেমে পড়ে যান তারা। তাদের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তাও হয়। ইত্যবসরে প্রেমের টানে ক্যাম্প থেকে আরাফাতের সাথে পালিয়ে যান আজিদা। পরিবারের অজান্তেই দুইজনের বিয়ে সম্পন্ন হয়। স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই বসবাস করতে থাকেন আজিদা ও আরাফাত।
এভাবে এক মাস কেটে যাওয়ার পর আরাফাতের আচার-ব্যবহার, চালচলন সন্দেহ হতে থাকে আজিদার। তিনি টের পান তাকে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। খবর দেন মাকে। সাইট ব্লক-৮১ এর মাঝি সৈয়দ হোসেন জাতীয় মানব কল্যাণ মিশনকে (জেএমকেএম) বিষয়টি অবহিত করেন। জেএমকেএম সাইট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সিআইসিকে অবহিত করে। যোগাযোগ হয় পদুয়া ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার শফির সাথে। অবশেষে লোহাগাড়া থানার ওসি সাইফুল ইসলামের মাধ্যমে ভিকটিম আজিদাকে ক্যাম্প-১৭তে ফিরিয়ে আনা হয়।
শুধু আজিদার মা নন, খালা ও নানীও ছিলেন বিধবা। তাই আশা ছিল, আরাফাতের সাথে গেলে হয়তো পরিবারের অভাব ঘুচবে। বিধবা মাকে কিছুটা হলেও শান্তি দেয়া যাবে। কিন্তু ঘটে যায় এ বিপত্তি। অবশেষে স্থানীয় প্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে মুক্তির পথে ফিরে আসেন আজিদা।
মৃত্যু থেকে ফিরে আসেন আনোয়ার সাদেক
১৮ বছর বয়সী আনোয়ার সাদেক। তার পিতার নাম জাফর হোসেন, মাতা সুরা খাতুন। মিয়ানমারের আকিয়াবের বালুখালী কুমানি এলাকায় তাদের বাড়ি হলেও বর্তমান কুতুপালং ১৭ নং ক্যাম্পের বি ব্লকে তাদের ঠিকানা। এক ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে আনোয়ার সাদেক সবার বড়। মিয়ানমারের নুড়ং স্কুলে তিনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পাশাপাশি বাড়ির কাজকর্মও করতেন।
আনোয়ার সাদেকের ছোটকাল থেকে খুব ইচ্ছা ছিল মালয়েশিয়া যাওয়ার। স্বপ্ন ছিল বাড়ির অভাব দূর করবেন। অন্যদের মতো সুন্দর করে দুমুঠো ভাত খাওয়াবেন মা-বাবাকে। হাসি ফোটাবেন পরিবারের মুখে। সেই চিন্তা থেকে বছরখানেক আগে গোপনে চেষ্টা চালাতে থাকেন কিভাবে মালয়েশিয়া যাওয়া যায়?
যেই চিন্তা সেই কাজ। পেয়ে গেলেন একজন দালাল। সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়ার কথা ঠিকঠাক। মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় চুক্তি হয় আয়াস নামের মিয়ানমারের এক দালালের সাথে। চুক্তি মতে, বাংলাদেশে দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা। বাকি ৭০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছে হাসান নামের এক দালালকে পরিশোধ করলেই চলবে।
সিদ্ধান্ত ফাইনাল। রওনা দেবেন মালয়েশিয়া উদ্দেশে। দুই হাজার টাকা ভাড়ায় একটি টমটম ঠিক করেন আনোয়ার। ক্যাম্প থেকে ওই টমটমে কক্সবাজার শহরের প্রবেশদ্বার লিংকরোড়ে পৌঁছেন আনোয়ার সাদেক। মাঝপথে মিডিয়া করেন গফুর নামের বাংলাদেশী এক দালাল। আনোয়ার সাদেককে একটি বাসে চকরিয়ায় নিয়ে যান গফুর। সেখান থেকে রিজার্ভ সিএনজিতে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় তাকে নামানো হয়। ওখানে একটি হোটেলে দুই দিন রাখেন দালাল গফুর। বিনিময়ে গফুরকে দিতে হয় ২০ হাজার টাকা।
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ার সাদেকসহ ১২ জনকে মালয়েশিয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে একটি কাঠের বোটে তুলে দেন দালাল গফুর। বোটের মধ্যে দা, কিরিচসহ বেশ কিছু অস্ত্র ছিল।
বোটে উঠতেই শুরু হয় লঙ্কাকাণ্ড। সবার পকেটের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়া হয়। ছোট্ট একটি কাঠের বোটে তারা শ’খানেক লোক ছিলেন। ভালোমতো বসাও যাচ্ছিল না। ছোট্ট বোটে দুই দিন পার হয়ে যায়। চরম ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন যাত্রীরা। তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঠিক এমন সময় তাদের বহনকারী বোটটি ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকতে থাকে। এ অবস্থায় সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। প্রাণভয়ে চার দিকে কান্নার আওয়াজ। দালাল ও বোটের মাঝিরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন যাত্রীদের বাঁচাতে। ইতোমধ্যে অনেকে ভয় ও ক্ষুধায় রক্তবমি করে দেন। যাত্রীদের মধ্য থেকে ১১ জন পানিতে লাফ দেন, সেখান থেকে একজন মারাও যায়। এ অবস্থা দেখে পাশে থাকা দু’টি যাত্রীবাহী বোট এসে তাদের তুলে নেয়। ওই বোটে আনোয়ার সাদেক কুতুবদিয়ায় যান। পরে বিভিন্ন লোকের সহায়তায় সেখান থেকে চকরিয়া হয়ে লিংকরোডে পৌঁছেন। এভাবে একটি মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থা থেকে নিরাপদ জীবনে ফিরে আসেন আনোয়ার সাদেক। তিনি বর্তমানে ক্যাম্পে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বসবাস করছেন।
যাদের হাত ধরে সুন্দর একটি জীবন ফিরে পেয়েছেন সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আনোয়ার সাদেক। সেই সাথে দালালের হাত ধরে ভুল পথে পা না বাড়ানোর জন্য সবার কাছে অনুরোধ করেছেন তিনি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-