বাংলা ট্রিবিউন •
দেশজুড়ে মরণ নেশা ইয়াবার ছড়াছড়ির কারণে পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিটের সেদিকেই নজর বেশি। কিন্তু এরই ফাঁকে রাজধানীসহ সারাদেশে নতুন করে চোরাচালান বেড়েছে ফেনসিডিলের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, ইয়াবার পাশাপাশি ফেনসিডিলে আসক্তির প্রবণতা বাড়ছে। আগের তুলনায় ফেনসিডিলের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। এই মরণ নেশায় ব্যাপকহারে আসক্ত হয়ে পড়ছেন চাকরিজীবী, তরুণ-তরুণী ও বিত্তশালী পরিবারের সদস্যরা।
জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন মাদক স্পটে এখন প্রতিটি ফেনসিডিলের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৪শ’ থেকে দুই হাজার টাকায়। সাধারণত বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ, বিশেষ করে ব্যাংকার, চিকিৎসকসহ উচ্চবিত্ত তরুণরা ফেনসিডিল সেবন করছে বেশি। বছর কয়েক আগে ইয়াবার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ায় ফেনসিডিলের চোরাচালান কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু এই প্রবণতা নতুন করে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন,বাংলাদেশের অন্তত ১৯টি সীমান্তঘেষা জেলার ওপারে (ভারতে) নতুন করে ফেনসিডিলের কারখানা স্থাপন করেছে মাদক কারবারিরা। রাতের আঁধারে সীমান্ত হয়ে সেসব ফেনসিডিল আসছে ঢাকায়। নানা কৌশলে সেসব ফেনসিডিল নেওয়া হচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। গত জুলাইয়ে ঢাকার পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে ফেনসিডিলের চোরাচালান বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গেওে আলোচনা হয়। বৈঠকে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে তুলে ধরা এক প্রতিবেদনে অন্তত ১৯টি জেলার সীমান্ত দিয়ে দেশের ভেতরে ফেনসিডিল প্রবেশ করছে বলে উল্লেখ করা হয়।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, একসময় ফেনসিডিলই ছিল অন্যতম প্রধান মাদক। ইয়াবার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ফেনসিডিলের গুরুত্ব অনেকটা কমে গিয়েছিল। এছাড়া, সীমান্তের ওপারে ফেনসিডিলের যত কারখানা ছিল, ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা ধ্বংস করে দিয়েছিল। একারণে ফেনসিডিলের সরবরাহ কমে গিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই সরবরাহ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ফেনসিডিলে আসক্ত হওয়ার প্রবণতাও ফের বাড়ছে।
ইয়াবামাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ওই কর্মকর্তা জানান, তারা বিভিন্ন সময়ে ফেনসিডিল উদ্ধারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন— সাম্প্রতিককালে এই মাদকের চোরাচালান ২৫ দশমিক ৫৭ ভাগ বেড়েছে। গত বছরের পয়লা এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে সারাদেশে এক লাখ ৬২ হাজার ৭৮২ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু এর পরবর্তী ছয় মাসে অর্থাৎ গত বছরের পয়লা অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে দুই লাখ চার হাজার ৪০৯ বোতল।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বলেন, ‘ফেনসিডিলের প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর নেই, বিষয়টি সে রকম নয়। আমরা নিয়মিত ফেনসিডিলও উদ্ধার করছি। মামলা হচ্ছে, মাদক কারবারিরা গ্রেফতারও হচ্ছে। তবে এটা সত্য যে, মাঝখানে একটু কমে আসলেও ফেনসিডিলের চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমরা অন্যান্য মাদকের মতো এটিও নির্মূলের চেষ্টা করছি।’
ফেন্সিডিল আসছে যেভাবে
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়— সীমান্তবর্তী ১৯টি জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল আসছে। এসব জেলা ও স্থান হলো— সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনী। ওই প্রতিবেদনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, মালদা, কুচবিহারের পাশের ফলাকাটা, মেঘালয়ের তুরা ও সিলেট সীমান্তের অদূরে জোয়াই এলাকায় ফেনসিডিলের কারখানা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এসব এলাকা থেকে ফেনসিডিল সংগ্রহ করে মাদক কারবারিরা সুবিধামতো সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে পাচার করে দেয়।
মাদকদব্র্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কর্মকর্তা জাফরুল্লাহ কাজল বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে থাকা কারখানাগুলো একটা সময় বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো নতুন করে চালু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিল আনার চেষ্টা করছে চোরাচালান চক্রের সদস্যরা। আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করছি। ফেনসিডিলও জব্দ করা হচ্ছে।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক ইউনিট বিভিন্ন সময়ে বহনকারী ও মাদকব্যবসায়ীসহ অসংখ্য ফেনসিডিলের চালান জব্দ করেছে। বিভিন্ন সময়ে ফেনসিডিলের চালান উদ্ধারকারী অন্তত সাত জন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্ত থেকে কয়েকবার হাত বদলের মাধ্যমে ফেনসিডিলের চালানগুলো সাধারণত রাজধানী ঢাকায় আসে। বিশেষ করে পণ্যবাহী ট্রাকের ভেতরে করে ফেনসিডিল আনা হয়। ফলে আগে থেকে জানা না থাকলে খালি চোখে কেউ দেখে বুঝতে পারবে না। এছাড়া, গাড়িতে বিশেষভাবে কেবিন বা চেম্বার তৈরি করে সীমান্ত এলাকা থেকে ফেনসিডিলের বড় বড় চালান আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার মাদকব্য কারবারিরাও বলেছে, বর্তমানে ঢাকার যেকোনও এলাকায় ফেনসিডিলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। একারণে ফেনসিডিলের দামও এখন আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় যারা চোরাকারবার করে তারা শুধু সীমান্তের ওপার থেকে ফেনসিডিলের চালান এপারে এনে দেয়। সীমান্ত পার করে আনা ফেনসিডিল হাত বদল হয়ে অন্য মাদক কারবারিদের কাছে চলে যায়। তখন তারা নিজেদের হেফাজতে মজুত করে রাখে। এরপর রাজধানী ঢাকা বা অন্য কোনও এলাকার মাদক ব্যবসায়ীর কাছে তা বিক্রি করে দেয়।
সীমান্তে ৩০০, ঢাকায় ১৫০০
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও দিনাজপুর জেলার হিলির এক ফেনসিডিল কারবারির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সীমান্ত এলাকায় এখনও ৩০০ টাকায় এক বোতল ফেনসিডিল বিক্রি হয়। স্থানীয় রাজনীতিক, পুলিশসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মাসোহারা দিয়ে সেটি ঢাকার পাইকারি বিক্রেতার কাছে বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। ঢাকায় পাইকারি বিক্রেতারা খুচরা বিক্রেতার কাছে প্রতি বোতল ফেনসিডিল বিক্রি করে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায়। এরপর খুচরা বিক্রেতারা প্রতিটি বোতল ১২০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। সরবরাহ কম থাকলেই কেবল দাম বেড়ে যায়।
ফেনসিডিলসহ আটক তিন মাদক কারবারিনাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হিলির ওই ফেনসিডিল ব্যবসায়ী জানান, ফেনসিডিলের একটি চালান ঢাকায় পাঠাতে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেককেই টাকা দিতে হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তাও জানান, মাদকসহ যে কোনও গাড়ি পার করে দেওয়ার জন্য ‘টোকেন’ ব্যবস্থা থাকে। টোকেন দেখিয়ে পথের চেকপোস্টগুলোতে পার পায় তারা।
ফেনসিডিল উদ্ধারের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সারাদেশে দুই লাখ ৬৭ হাজার ৭২৫ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। ২০১৭ সালে উদ্ধার হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার ৪৮০ বোতল। ২০১৮ সালে উদ্ধার করা হয় তিন লাখ ৫৭ হাজার ৭৭১ বোতল। আর এবছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে উদ্ধার করা হয়েছে এক লাখ ৬৩ হাজার ৬৫ বোতল।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবি এবছরের জানুয়ারিতে ৩৫ হাজার ৫৯৬ বোতল, ফেব্রুয়ারিতে ৩৫ হাজার ৭৫৪, মার্চে ৩২ হাজার ৮৯৫ বোতল, এপ্রিলে ২৯ হাজার ৩৩৬ বোতল, মে মাসে ৩১ হাজার ৫৫ বোতল এবং জুনে ৩৫ হাজার ৭৫৫ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তারা এক লাখ ৩১ হাজার ২৩৩ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছিল। এ বছরের অর্ধেক সময়েই ফেনসিডিল উদ্ধারের সংখ্যা লাখ পেরিয়ে গেছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-