রোহিঙ্গা মহা-সমাবেশের মদতদাতারা চিহ্নিত

বাংলা ট্রিবিউন •

প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের মহাসমাবেশের পেছনে জড়িতদের শনাক্ত করেছে তদন্ত কমিটি। গত ৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত একটি তদন্ত প্রতিবেদন এনজিও ব্যুরোতে পাঠানো হয়। এতে চিহ্নিত মদতদাতাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নেতা ছাড়াও কক্সবাজারের এনজিও, আইনজীবী, কলেজের প্রভাষক, ‘আরআরসি’র কর্মকর্তা ও পুলিশসহ একাধিক সংগঠনের কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে।

মদতদাতা হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তারা হলেন—আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটি রাইটস (এআরএসপিএইচ)-এর সভাপতি মুহিববুল্লাহ, সহ-সভাপতি মাস্টার আব্দুর রহিম, সাধারণ সম্পাদক ও উখিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক নূরুল মাসুদ ভূঁইয়া, সংগঠনের উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দুলাল মল্লিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. ফরিদুল আলম ও মাওলানা ইউসুফ, কক্সবাজার জেলা দায়রা জজ আদালতের পিপি মাহবুবুর রহমান, কক্সবাজার জেলা দুর্নীতি দমন কমিশনের পিপি মো. আব্দুর রহিম ও ক্যাম্পে নিয়োজিত পুলিশের এএসআই বোরহান উদ্দিন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত মাসের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে উখিয়ার কুতুপালং এক্সটেনশন-৪ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মহাসমাবেশ করে রোহিঙ্গারা। প্রশাসন থেকে অনুমতি না নিয়ে কিছু রোহিঙ্গা নেতার সঙ্গে যোগসাজশ করে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে গঠিত ‘ভয়েস অব রোহিঙ্গা’ এবং রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটির (আরআরসি) পক্ষ থেকে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ভয়েস অব রোহিঙ্গা ৭০০ সাদা হাফ টি-শার্ট ও ২৮টি ব্যানার উখিয়া উপজেলার মসজিদ মার্কেটের নিশাত প্রিন্টার্স ও মিডিয়া প্রিন্টার্স থেকে ছাপানো হয়। রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিউনিটি (আআরসি) সংগঠনের ১০০ হাফ টি-শার্ট ছাপানো হয়েছে কক্সবাজার বাজারঘাটা শাহ মজিদিয়া প্রিন্টার্স থেকে। এছাড়া, এআরএসপিএইচ এবং এনজিও সংস্থা ‘এডিআরএ’ ও ‘আল মারকাজুল ইসলামী সংস্থা’ নামে দুটি এনজিও সমাবেশে রোহিঙ্গাদের টি-শার্ট ও ব্যানার সরবরাহ করেছে। এআরএসপিএইচ-এর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীসহ কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতের একজন পিপি, দুর্নীতি দমন কমিশনের পিপি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক এবং ক্যাম্পে কর্মরত এক এএসআই এই মহাসমাবেশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রোহিঙ্গাদের সামাবেশের আগে ‘এডিআরএ’ নামের একটি এনজিও গত ১৯ ও ২১ আগস্ট কক্সবাজারের কলাতলির শালিক রেস্তোরাঁয় বৈঠক করে। বৈঠকে আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে আড়াই লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। এছাড়া ‘আল মারকাজুল ইসলামী সংস্থা’ সমাবেশে রোহিঙ্গাদের জন্য টি-শার্ট তৈরিতে সহযোগিতা করে। পরে ২৫ আগস্ট কুতুপালংয়ের মধুরছড়া এক্সটেনশন-৪ ক্যাম্পে মহাসমাবেশ করে রোহিঙ্গারা। এছাড়া, নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফুটবল খেলার মাঠ ডি-৫ ব্লকে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনের পক্ষে সমাবেশ ও র‌্যালি করা হয়। সমাবেশ সফল করতে ডি-৫ ব্লকে আরআরসি সংগঠনের চেয়ারম্যান সিরাজুল মোস্তফার নেতৃত্বে ২৫ হাজার টাকা করে চাঁদা সরবরাহ করা হয়। সংগঠনের সেক্রেটারি সাইফুল হকের নিকটাত্মীয় ও স্বজন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করায়, তাদের কাছ থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। বিশেষ করে লন্ডনে বসবাসরত নূরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি প্রায় ৫-৬ মাস আগে সংগঠনের (আরআরসি ) অফিস নির্মাণের জন্য ২ লাখ টাকা অনুদান দেন। এই সংগঠনের মূল কমিটি ২৫ জনের। সমাবেশের টি-শার্ট তৈরি করতে ক্যাম্পে কর্মরত পুলিশের এএসআই বোরহান উদ্দিনের মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয় বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশ কিছু সংগঠন কাজ করলেও মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত এআরএসপিএইচ সংগঠনটি বেশ শক্তিশালী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। মুহিবুল্লাহর সংগঠনের ৩০০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন—উখিয়া সিকদার পাড়া এলাকার আব্দুল করিম ভূঁইয়ার ছেলে উখিয়া কলেজের প্রভাষক নূরুল মাসুদ ভূঁইয়া। ২৫ আগস্ট তিনি উপজেলার মানবাধিকার সংগঠন ‘পিসওয়ে হিউম্যান রাইটস সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি সমাবেশে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মাসুদের পূর্ব পুরুষ মিয়ানমারের নাগিরক বলেও উল্লেখ করা হয়। এই সংগঠনের সাত সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে, যারা সবাই কক্সবাজারের স্থায়ী বাসিন্দা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারের একটি মিটিং হয়। এরপর তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই ঘটনায় ছয়টি এনজিওকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া তদন্তে যেসব প্রতিষ্ঠান এবং কর্মকর্তাদের নাম আসছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারে দুর্নীতি দমন কমিশনের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) অ্যাডভোকেট মো. আবদুর রহিম জানান, ‘প্রতিবেদন সম্পর্কে আমি শুনেছি। প্রতিবেদনটি  যারা জমা দিয়েছেন, তারা কি আমাদের বক্তব্য নিয়েছেন? যে সংগঠনগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেখানে কি আদৌ আমরা সম্পৃক্ত? এটা কেউ কি প্রমাণ করতে পারবে? আমি একজন আইনজীবী মানুষ। আমি সারাদিন আদালতে ব্যস্ত থাকি মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে। সেখানে রোহিঙ্গাদের আমি কীভাবে সহায়তা করলাম, তা আমার বোধগম্য নয়।’

আরও খবর